করোনার প্রভাবে বড় ধরনের মন্দায় পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কমতে পারে ৫ থেকে ৭ শতাংশ। ক্ষতির তালিকায় উপরের দিকে থাকবে ইউরোপ আমেরিকা। তবে কিছুটা ভালো অবস্থানে থাকবে এশিয়ার কিছু দেশ। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান ক্রেতা ইউরোপ ও আমেরিকা। এসব অঞ্চলের অর্থনীতি মন্দার কারণে বাংলাদেশের উচিত হবে নতুন বাজার খোঁজা। এক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলো একটি ভালো বিকল্প বাজার হতে পারে। করোনায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রভাব ও আসছে বাজেট নিয়ে ইআরএফ মিডিয়ার সাথে আলাপকালে এসব কথা বলেন, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাাফিজুর রহমান।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে গবেষণা করা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, করোনার প্রকোপে বাংলাদেশের রপ্তানি বিপর্যস্ত হয়েছে। শুধু যে তৈরি পোশাকখাত ক্ষতিগ্রস্থ তা নয় বরং পাট, চামড়া থেকে শুরু করে সব ধরনের রপ্তানিখাতই ক্ষতির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে সরবরাহ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার আমদানিও ব্যাহত হয়েছে। বড় ধরনের ব্যয় হয়েছে এই খাতে। বন্দরের কার্যক্রম থমকে যাওয়ায় বন্ধ ছিল আমদানিও। আবার প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও ক্ষতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে অর্থনীতি এখন বিপর্যস্ত।
বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন এই অর্থনীতিবিদ। করোনার ফলে উদ্বুভ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মোকাবিলা করতে না পারলে বিদেশি বিনিয়োগ আসায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণও কমে আসতে পারে বলে তার ধারণা। বিশেষ করে দ্বিপাক্ষিক ভাবে যেসব দেশ বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে সহায়তা দিয়ে আসছে, তাদের সহায়তার পরিমাণ কমতে পারে। করোনার ফলে ঐসব দেশই বিপর্যস্ত। এমন বাস্তবতায় সাহায্যের পরিমাণ বাড়াবে আশা করা যায় না। তবে বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলো (যেমন বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবল) থেকে সাহায্যের পরিমাণ বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, আসছে বাজেটে কোভিডের অভিঘাত কাটিয়ে উঠার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানির সাথে যুক্ত খাতগুলোতে যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎপাদন অব্যাহত রাখা যায় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এসব শিল্পকে যে সহায়তা দেয়ার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারিদের বেশি সহায়তা করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে যেন, এসব শিল্প মালিকরা দেউলিয়া হয়ে না পড়ে। এই দুর্যোগে যেন তারা টিকে থাকতে পারে, সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন তিনি।
বৈশ্বিক মন্দা কোন দিকে যাবে, এই মন্দা থেকে উত্তরণই বা কিভাবে হবে সেটা এখনো সুনিশ্চিত নয়। মন্দা দীর্ঘ হবে নাকি স্বল্প হবে, তা এখনো কেউ আন্দাজ করতে পারছে না। সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা, শিল্পখাতকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করবে ঠিকই। তবে এই প্রণোদনার অর্থ সঠিক ভাবে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়ে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যেসব খাতের চাহিদা তৈরি হবে সেগুলোকে বেশি করে সহায়তা দিতে হবে। রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়াতে হবে।
বাজার বৈচিত্র্যের জন্যও চেষ্টা করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। প্রতিযোগী দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার কথা তুলে ধরে বলেন, এগুলো বাংলাদেশের জন্য প্রতিযোগী দেশ। চীনের অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী এসব দেশে চলে আসছে। বাংলাদেশকেও এই সুযোগ নিতে হবে। এই সুযোগ ধরতে গেলে দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা বাড়াবে। এজন্য উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং উৎপাদন খরচ কমাতে ব্যবসা শুরুর ব্যয় কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
করোনা আগেই চীন-যুক্তরাষ্ট্র যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছিল, করোনার পরবর্তী সেটি আরো বাড়তে পারে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে লিড টাইম কমিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ ক্রেতার হাতে সময়মতো পণ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ড. মোস্তাফিজ বলেন, এই দিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। সরকারের প্রণোদনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, কোন পণ্যের ক্ষেত্রে দিলে বেশি লাভবান হওয়া যাবে সেটা দেখতে হবে। প্রণোদনার একটি কাঠামো তৈরি করা উচিত। কোন খাতকে কেন প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে তা যেন পরিষ্কার থাকে। কোডিভের কারণে নতুন অনেক ব্যবসার সুযোগ তৈরি হবে, সেগুলোও যেন সহযোগিতার আওতায় আসে তা দেখতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বিভিন্ন দেশ দ্বিপাক্ষিক ভাবে ঐসব দেশের সাথে আলোচনা করছে। প্রবাসী শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো ঠেকাতে বাংলাদেশকেও এই ক্ষেত্রে আলোচনা করতে হবে। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরকে প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে। আগামীতে যেহেতু এশিয়ার অর্থনীতি এগিয়ে থাকবে, সেক্ষেত্রে এসব দেশে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা তৈরি হবে।
সম্প্রতি দ্যা ইকোনোমিস্ট পত্রিকায় কোভিড-১৯ এর অভিঘাত বিশ্লেষণ করে বলেছে, অন্যের প্রতি নির্ভরশীলতার দিন শেষ, সময় এসেছে বিশ্বায়নকে বিদায় জানানোর। তবে এর সাথে এক মত নন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, বিশ্বায়নের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেলে কম মূল্যে পণ্য কেনার সুযোগ হারাবে উন্নত বিশ^। ড. মোস্তাফিজ বলেন, বিশ্বায়নের সুযোগ নিয়েই বাংলাদেশের মত ছোট অর্থনীতির দেশগুলো এত উন্নতি করতে পেরেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পে। এর বাইরেও গড়ে ওঠেছে অনেক শিল্প ও সেবাখাত।
তবে এটা ঠিক যে করোনার প্রভাবে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া একটি বড় ধাক্কার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জানান, ইতিমধ্যে বিশ্বের ৮৪টি দেশ সংরক্ষণশীল নীতিতে চলে গেছে। এসব দেশ চেষ্টা করবে আমদানি যত কম করা যায়। এ লক্ষ্যে তারা নিজস্ব সক্ষমতা যেমন বাড়াবে তেমনি আমদানি পর্যায়ে শুল্ক আরোপও বাড়াতে পারে। এক্ষেত্রে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। তবে বাংলাদেশের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে না। চীনের মত বড় দেশগুলো যতটা চাপে পড়বে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হবে না বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
কারণ হিসেবে তিনি ব্যাখ্যা করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছোট হলেও শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা রয়েছে। অর্থাৎ উৎপাদিত পণ্যের বেশির ভাগ অংশই এই দেশের ভোক্তারাই ক্রয় করে থাকেন। তার হিসেবে, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৮৫ শতাংশ কর্মকাণ্ড অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় শক্তি। এটাকে ব্যবহার করতে হবে। করোনার ধাক্কায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। এটিকে বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে সচল রাখাই আসছে বাজেটের অন্যতম বড় উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।