করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্বঅর্থনীতি। ক্ষতির মুখে বাংলাদেশও। এমন বাস্তবতায় আসছে নতুন অর্থবছরের বাজেট। করোনায় নতুন বছরের বাজেটে করনীয় কী? এ নিয়ে ইআরএফ মিডিয়ার সাথে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তাঁর মতে, সরকারকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে ছোটার মানসিকতা পরিহার করে, আসছে বাজেটে অর্থনীতিকে সচল রাখার সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি মনে করেন, স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা করে ব্যবসাবাণিজ্য ও অর্থনীতিকে সচল করতে পারলে প্রবৃদ্ধি মন্থর হবে, কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতি উতরানো যাবে।

সালেহউদ্দিন আহমেদের অনুমান, সমাপ্ত হতে যাওয়া অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রবৃদ্ধি ৪ থেকে ৫ শতাংশের বেশি হবে না। এই প্রবৃদ্ধিকে বাড়ানোর জন্য তাড়াহুড়ো না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সচল অর্থনীতির গতি মন্থর থাকলেও ধীরে ধীরে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। কল্যাণমুখী বাজেট প্রণয়ন করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবাবের বাজেটের লক্ষ্য হওয়া উচিত; উচ্চ প্রবৃদ্ধি নয়, সচল অর্থনীতি। সেই সাথে নতুন বাজেটকে পরবর্তী অর্থবছরের সাথে (২০২১-২২) সামঞ্জস্য রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এর বাইরে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মত দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার সাথে বাজেটের যোগসূত্র রাখার পরামর্শও দেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, এবারে বাজেট প্রণয়নের গতাগুনিক ধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। করোনার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া বৈশি^ক প্রভাবের কারণে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হওয়া, রেমিটেন্স কমে আসার মত বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাজেটে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেটে অর্থের সংস্থানে করফাঁকি ও অপচয় বন্ধ এবং প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে আনার পরামর্শ তার। উন্নয়ন বাজেটে নেয়া প্রকল্পগুলো যেন করোনা মোকাবেলায় ভূমিকা রাখে সে বিষয়ে নজর দিতে বলেছেন তিনি। নতুন অর্থবছরে আয় বাড়াতে কোন ভাবেই করহার বৃদ্ধি না করে, করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ তার। সেই সাথে ব্যক্তি করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর কথা বলেছেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।

এছাড়া রাজস্ব বোর্ডের দক্ষতা বাড়ানো ও রাজস্ব বোর্ড বর্হিভূত কর আহরণ বাড়ানোর পরামর্শ তার। এক্ষেত্রে করের হার যাতে না বাড়ানো হয় সেদিকে নজর রাখার কথা বলেছেন তিনি। বলেন, যেমন ধরুন এমনিতেই জমির নিবন্ধন ফি অনেক বেড়ে গেছে। এটা যদি আরো বাড়ানো হয় তাহলে মুশকিলে পড়বে সাধারণ মানুষ। এছাড়া ফ্ল্যাট কেনার রেজিস্ট্রেশন ফিও বেশি। এগুলো না বাড়িয়ে বরং এসব ক্ষেত্রে যে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি হয়, নতুন অর্থবছরে তা কঠোর হাতে বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন সালেহউদ্দিন।তার মতে, করোনা দুর্যোগে সাধারণ মানুষের হাতে এমনিতেই টাকা নেই। ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজস্ব বোর্ডের উচিত হবে খুব সহজ ভাবে কর আহরণ করা। এমন কোন পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে না যাতে, মানুষের হাত থেকে টাকা শুষে নেয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়।

অর্থের যোগানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি ক্রিয়েশন এর উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর। তবে এখনই টাকা ছাপানোর বিপক্ষে তিনি। রেপো ও সিআরআর কমানোর ফলে ব্যাংকের হাতে নগদ অর্থের সংস্থান হবে। একই সাথে এসএলআর কমাতে পারলে ব্যাংকের হাতে আরো ৩০ হাজার কোটি টাকা আসবে বলে তিনি মনে করেন। এছাড়া অর্থের সংস্থান বাড়াতে সরকারকে বন্ড ছাড়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, এই বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের কাছ থেকে কিনে নিবে। এতেও সরকারের হাতে নগদ টাকা আসবে।

এছাড়া ওয়েজ এন্ড মিলস নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে তহবিল আছে সেখানে থেকেও সরকার অর্থ সংগ্রহ করতে পারে বলে মনে করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। এই তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে সরকার তার নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে পারে। করোনা পরিস্থিতির কারণে তহবিলের সীমা বাড়ানো যেতে পারে উল্লেখ করে তিনি জানান, ইতিমধ্যে ভারতের কেন্দ্র্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এই সীমা বাড়িয়েছে।
এভাবে অর্থ যোগাড়ের ফলে, মূল্যস্ফীতি অতটা বাড়বে না বলে মনে করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ আসবেই উল্লেখ করে বলেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের উচিত হবে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেয়া। আসছে অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশেই ধরে রাখতে হবে এমন মনোভাব থেকে সরে এসে, ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎসের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর পরামর্শ তার। সর্বোপরি মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার কথা পরামর্শ সাবেক এই গভর্নরের।

বাজেটে ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারকে অগ্রাধিকার খাতের তালিকা তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি মনে করেন, নতুন বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বাড়াতে হবে। সম্ভাব্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির যে পরিকল্পনা প্রকাশ হয়েছে, তাতে এই খাতে মাত্র ১৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। এই বরাদ্দ অত্যন্ত কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর পরিমাণ বাজেটের ৪ থেকে ৫ শতাংশও হবে না। নতুন বছরে পরিবহনখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকলেও সেই অনুপাতে স্বাস্থ্যখাতের কম বরাদ্দের সমালোচনা করেছেন তিনি। এর বাইরে শিক্ষাখাতেও ব্যয় বাড়নোর ওপর জোর দিয়ে তার পরামর্শ, কারিগরী শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।
নতুন বাজেটে কর্মসংস্থান বাড়ানোর ওপর বিশেষ জোর দেয়ার কথা বলেছেন তিনি। এ লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে কাজ করার পরামর্শ তার। সালেহউদ্দিন বলেন, লকডাউন শিথিল করে সরকার বড় শিল্পগুলোকে খুলে দিয়েছে। কিন্তু উচিত ছিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছোট ছোট শিল্প চালু করা। এসব শিল্পে শ্রমিকদের সংখ্যা কম তাই স্বাস্থ্যবিধি মানাও সহজ বলে তার অভিমত। সামাজিক সুরক্ষায় যথেষ্ট বরাদ্দ রাখা ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির পরামর্শ তার। এছাড়া স্বাস্থ্য বীমার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অনেক ছোট ছোট প্রকল্প থাকে যেগুলোর প্রয়োজনীয়তা খুব একটা নেই সেগুলো বাদ দেয়ার পরামর্শ তার। তবে কৃষিখাতে বিশেষ জোর দিতে হবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও কর্মসংস্থানের বিবেচনায় এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এছাড়া শস্যবীমা ভালোভাবে চালু করার কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি মনে করেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানোই শেষ কথা নয় বরং বাস্তবায়নের ওপরই সরকারকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার বিষয়ে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক নির্ভর প্রণোদনা বাস্তবায়ন কিছুটা চ্যালেঞ্জ হবে। যদিও ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে নিয়ে যাওয়া ব্যাংকের অন্যতম কাজ উল্লেখ করে সাবেক এই গভর্নর বলেন, ব্যাংকগুলোতো কম সুদে আমানত নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে উচ্চ সুদ ফেরত দেয়ার চাপ থাকবে না। প্রণোদনা বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং বাড়ানো উচিত বলে তার অভিমত।

করোনা পরবর্তী ঋণ প্রদানে ব্যাংকগুলোকে দীর্ঘ সূত্রিতা পরিহারের আহবান জানিয়েছেন তিনি। নানামুখী চাপের ফলে ব্যাংকের আয় কিছুটা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তবে এখন যেহেতু স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয় তাই আপাতত ব্যাংকের অত লাভের প্রয়োজন নেই বলেও তিনি মনে করেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো কোন লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে না, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন সাবেক এই গভর্নর। তিনি বলেন, এই সময়ে লাভের মানসিকতা কমাতে হবে। তবে সুদ মওকুফের জন্য ব্যাংক যে ক্ষতির মুখে পড়বে তা পূরণে সরকারকে রাজস্ব খাত থেকে ভর্তুকি দেয়ার আহবান জানিয়েছেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *