করোনার দুর্যোগ মোকাবেলার মত বড় চ্যালেঞ্জকে মাথায় নিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হবে। যেখানে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা ও কৃষিখাতের গুরুত্ব্ বেশি থাকবে। রাজস্ব আয় কম হওয়ার সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে বৈদেশিক সাহায্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সরকারি ব্যয় কিছুটা সংকোচন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় এমন প্রকল্প নেয়া হবে আসছে বাজেটে। নতুন অর্থবছরের বাজেট বিষয়ে ইআরএফ মিডিয়াকে এসব তথ্য জানিয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. শামসুল আলম।
দুর্যোগপূর্ণ অর্থনীতি
তিনি বলেন, দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বাজেট হচ্ছে। যখন অর্থনৈতিক কর্মকা- বাধাগ্রস্থ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতেও ছুটি চলছে। জরুরী সেবাদান ছাড়া অন্য সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ছে। শুধু বাংলাদেশ নয় সারা পৃথিবীর অর্থনীতিই ক্ষতির মুখে উল্লেখ করে শামসুল আলম বলেন, অনেক দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক না হলেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হবে না। তার আশাবাদ, আমাদের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিই থাকবে। জাতিসংঘ দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমন একটি পরিস্থিতিতে আমরা বাজেট দিতে যাচ্ছি। উপরের সবগুলো প্রভাব বিবেচনায় রেখেই বাজেট দেয়া হবে বলে তিনি জানান।
বাজেটের আকার
শামসুল আলম বাজেটের আকার বিষয়ে জানান, এবারে বাজেটের আকার তত বড় হবে না। অত বড় করার সুযোগও নেই। অর্থনৈতিক কর্মকা- ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও আমদানি-রপ্তানি এমনিতেই কম। তাই বাজেট অত বড় করা যাবে না। তার মতে, চলতি অর্থ বছরের চেয়ে ৫ থেকে ৭ শতাংশ বেশি হতে পারে নতুন অর্থবছরের বাজেট। উন্নয়ন বাজেটের আকারও এমন হারে বাড়বে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতের ব্যয় অনেক বাড়ানো হবে। কারণ কোভিড-১৯ মোকাবেলাই হবে সরকারের সামনে বড় লক্ষ্য। এজন্য বাজেটে যথেষ্ট অর্থবরাদ্দ রাখার প্রয়োজন আছে।
প্রকল্প প্রণয়ন
শামসুল আলম জানান, প্রকল্প প্রণয়নের ক্ষেত্রে এমন সব প্রকল্পের অনুমোদন অগ্রাধিকার পাবে যেগুলো কর্মসংস্থান নির্ভর। দরিদ্র বিমোচনে সহায়ক হয় এমন প্রকল্প বেশি নেয়া হবে। আসছে বাজেটে অন্যতম গুরুত্ব ও বরাদ্দ বাড়ানোর খাত হবে সামাজিক সুরক্ষা। ড. শামসুল আলম জানান, ৯০ লাখ মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বিভিন্ন ধরনের ভাতা ও সহায়তা দেয়া হচ্ছে। কোভিডের কারণে নতুন করে আরো ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হবে। যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ হারিয়েছেন, এই সহায়তা তাদেরকে খাদ্য কষ্ট থেকে রক্ষা করবে।
বিদেশি সহায়তা
অর্থনৈতিক কর্মকা-ের স্থবিরতায় রাজস্ব আয় কম হবে। তবে বিদেশি সহায়তা দিয়ে এই ঘাটতি কিছুটা পুষিয়ে নেয়া যাবে বলে মনে করেন শামসুল আলম। তার আশাবাদ, এখন পর্যপ্ত বিদেশি সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি আছে তাতে আগের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি সহায়তা পাওয়া যাবে। যেহেতু রাজস্ব কম আসবে, তাই আসছে অর্থবছরে বিদেশি সহায়তার পূর্ণ ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। তবে করোনায় উন্নত দেশগুলো আক্রান্ত হওয়ায় বাংলাদেশ কিভাবে আগের তুলনায় বেশি সহায়ত পাবে?
এমন প্রশ্নের জবাবে ড. শামসুল আলম বলেন, আমি যে সহায়তা বৃদ্ধির কথা বলেছি এটা বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ। যেমন: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ^ ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), এশীয়ান অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) ইত্যাদি। এসব সংস্থাগুলোর তহবিলে অনেক অর্থ পড়ে আছে। সেখান থেকেই করোনা মোকাবেলায় আগের চেয়ে আরো বেশি সহায়তা মিলবে বলে তার আশাবাদ। তবে তিনি স্বীকার করেন, দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো থেকে সহায়তার পরিমাণ আগের তুলনায় কম আসবে।
সরকারি ব্যয়
বাজেটে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে বলে মনে করেন শামসুল আলম। তিনি বলেন, যেসব খরচ না করলেই নয় সেগুলো করা হবে। এর বাইরে যেসব খরচ আছে, যেমন সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণসহ ইত্যাদি খরচ কমে আসবে। তিনি জানান, এই ধরনের ব্যয় সংকোচনের ফলে আসছে বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় কমে আসবে। উল্লেখ্য বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আসছে বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় কমানোর পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের উদাহরণ টেনে সিপিডি বলেছে, সরকার চাইলে প্রশাসনিক ব্যয় অন্তত ৫০ শতাংশ কমানো সম্ভব।
কৃষির গুরুত্ব
মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে কৃষির অবদান কমতে থাকলেও এখনো এই খাতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ শ্রমশক্তি নিয়োজিত। করোনায় খাদ্য সংকট মোকাবিলা ও কর্মসংস্থান বিবেচনায় কৃষিকে গুরুত্ব দেয়ার আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে কৃষির বড় ভূমিকা আছে উল্লেখ করে এই খাতকে রক্ষা করার আহবান জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. শামসুল আলম। তিনি জানান, এই করোনা দুর্যোগেও ইতিবাচক দিক হলো বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এই মৌসুমে ২ কোটি ২০ লাখ থেকে ৪০ লাখ টন বোরো ধান উৎপন্ন হয়েছে। তার ধারণা, এই ধান থেকে সারা বছরের চাল সরবরাহের ৬২ শতাংশ মেটানো যাবে।
কৃষির জন্য প্রস্তুতি
কৃষিখাতে চলমান প্রকল্পগুলো চালিয়ে নেয়ার আহবান জানিয়েছেন শামসুল আলম। এছাড়া তিনি জানান, সামনে আউশের মৌসুমের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। তবে বরাদ্দের পাশাপাশি কৃষি সংক্রান্ত আমদানি-রপ্তানি ও পণ্য পরিবহনকে সচল রাখার আহবান জানান এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, পাট বীজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাসায়নিক ভারতসহ অনেক দেশ থেকে আমদানি করা হয়। করোনার কারণে এই আমদানি ব্যাহত হলে আসছে মৌসুম গুলোতে কৃষি উৎপাদন কমে যেতে পারে।
কৃষির প্রণোদনা
অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যদি এতে ছেদ ঘটে তাহলে শহরের ভোক্তারা প্রয়োজনীয় শাকসবজি,মাছ মাংস পাবে না। সরকার কৃষি নিয়ে যথেষ্ট সচেতন আছে উল্লেখ করে পরিকল্পনা কমিশনের সিনিয়র সচিব মর্যাদার এই সদস্য জানান, ফলমূল ও শাকসবজি উৎপাদনের জন্য সরকার ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এছাড়াও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য যে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা রাখা হয়েছে সেটিও কৃষিখাতকে অনেক সহায়তা করবে বলে তার আশাবাদ।
তৈরি পোশাক ও রেমিটেন্স
তৈরি পোশাকখাত নিয়ে দু:শ্চিন্তা থাকলেও সময়ের ব্যবধানে তা কেটে যাবে বলে মনে করেন শামসুল আলম। তিনি আশা করেন, করোনার প্রকোপ কেটে গেলেই পশ্চিমা দেশগুলোতে কম মূল্যের কাপড়ের চাহিদা বাড়বে। তখন সেই সুযোগ বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারবে বলে তার আশাবাদ। তবে প্রবাসীদের পাঠানো আয় বা রেমিটেন্স নিয়ে দু:শ্চিন্তা সহজে কাটবে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ক্ষতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে বলে মনে করেন ড. শামসুল আলম।