corona-file

বিমল সরকার:

করোনার করাল ছোবলের মধ্য দিয়ে বড় দুঃসময় অতিক্রম করছি আমরা। বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন মানুষ। ঝড়ের সময় নয়, ঝড়টি থেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায়। ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক বিষয়বস্তু জান ও মাল। এরপরই আসে বাকি সবকিছুর হিসাব।

একটি উদাহরণ দিই। প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে পাকিস্তানে সরকারি ছুটি ধার্য করা হয়েছিল বছরে মোট ১৫ দিন। ১৯৫৮ সালেও দু’দিনের ব্যাংকের ছুটি বাদে ১৩ দিনের সরকারি ছুটি ধার্য ছিল।

কিন্তু একই বছরের শেষদিকে (১৯৫৮) জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতাসীন হয়ে সরকারি ছুটি তিনদিন কমিয়ে দিয়ে ১৯৫৯ সালের জন্য মোট ১০ দিন ধার্য করেন।

আকস্মিক সরকারি ছুটি এভাবে কমিয়ে দেয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে ‘ব্যয় সংকোচন’ এবং সরকারি অফিসগুলোয় ‘কাজের গতি বাড়ানোর’ কথা যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

নতুন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘সরকারি কর্মচারীরা একদিনের ছুটি ভোগ করলে কেবল বেতন ও ভাতা বাবদ জাতীয় অর্থ তহবিল থেকে ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৭৪৫ টাকা ব্যয় হয়’ (তথ্যসূত্র : সংবাদ, ৪ জানুয়ারি ১৯৫৯)।

যে সময়ের কথা (১৯৫৮) বলছি, তখন টাকায় তিন সের চাল কেনা যেত। অনুরূপভাবে একটি আস্ত মুরগিও পাওয়া যেত এক টাকায়। এছাড়া এক ভরি সোনার দাম ছিল ১২৫ টাকা। অতএব একদিনের ছুটির বিপরীতে ২৩ লাখ ৬৭ হাজার টাকা সাশ্রয়, কম কথা নয়। যা হোক, সে হিসাবটা ক্ষমতা দখলকারী সামরিক সরকারের।

মরণঘাতী করোনার প্রভাবে ১৭ মার্চ থেকে ঈদুল ফিতরের আগ পর্যন্ত দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ (টানা আনুমানিক ৯০ দিন)। অফিস-আদালতে দু-তিন দফা বাড়িয়ে ২৬ মার্চ থেকে টানা ৫ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে (৪১ দিন)।

পোশাক কারখানাগুলোর বেশির ভাগই বন্ধ। দেশব্যাপী চলছে লকডাউন। এক কথায়, অচল হয়ে পড়ে রয়েছে সাধারণ প্রশাসনসহ বলতে গেলে সবকিছু। জনস্বার্থে সীমিত পরিসরে ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্য ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মতোই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংককর্মীরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। গণপরিবহন বন্ধ।

দুর্দমনীয় এক ভাইরাসের নাম করোনা। এর আগ্রাসী থাবা দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। ভাইরাসটি গোটা মানবজাতিকে আজ কঠিন এক অগ্নিপরীক্ষার মাঝে ফেলে দিয়েছে। প্রতিদিন বিশ্বে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অগণিত মানুষ।

এর করাল গ্রাসে সারা দুনিয়া স্তব্ধ-স্তম্ভিত-কম্পমান, যা নির্বাক করে দিয়েছে গোটা মানবজাতিকে। সমস্যাটি কেবল জাতীয় নয়, পুরোপুরি বৈশ্বিক।

আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত যেমন-তেমন- আমেরিকা, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালিসহ উন্নত দেশগুলোও করোনা মোকাবেলায় রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। এ অঞ্চলেও কখন কোথায় কীভাবে এটি ভয়ংকর রূপে আছড়ে পড়ে, এর কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। আলামত ভালো ঠেকছে না।

এ ডাইনি-রাক্ষসী তার দুষ্টু নখদন্ত ও শাখা-প্রশাখা কেবল বাড়িয়েই চলেছে। সর্বত্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক। মনে হচ্ছে, সার্বিক অবস্থা খুবই ভয়াবহ। সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। দরকার ধৈর্য, সংযম ও আত্মরক্ষার।

সহজেই স্বীকার্য, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-তথ্য-গবেষণা-সচেতনতার দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে। আবার আবেগ-হুজুগ-গুজবের দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে।

বিরাজমান এমনই পরিস্থিতিতে আমাদের সরকারের উচ্চমহল থেকে শুরু করে সর্বত্র এক আওয়াজ, এক আহ্বান- জনগণকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘরে থাকতে হবে, স্বাস্থ্য নিয়ম-বিধি মেনে চলতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে করোনা প্রতিরোধে এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হতদরিদ্র ও সাধারণ মানুষ মনে মনে কিছুটা হলেও স্বস্তির সন্ধান পাচ্ছে।

স্মরণকালে এমন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে আমরা পড়িনি। কেবল আমাদের দেশ নয়, বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা হল, প্রাণঘাতী করোনার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে গোটা বিশ্বই এক মহা আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। কোনো হরতাল বা দৈবদুর্বিপাক নয়, একদম স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান আমলে একদিনের ছুটিতে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কী পরিমাণ টাকা খরচ হতো, তার উল্লেখ করা হয়েছে শুরুতেই।

বর্তমান হিসাব অনুযায়ী বোধকরি তা দৈনিক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ছুটিছাঁটা কারও ইচ্ছাকৃত বা মনগড়া কোনো ব্যাপার নয়। বিশ্বের দেশে দেশে সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন রাষ্ট্রের কর্মচারীদের জন্য ছুটি ভোগ করার বন্দোবস্ত করাই আছে। কিন্তু আমাদের মতো একটি দেশে করোনার কারণে দেড় মাসের সাধারণ ছুটি, ভাবা যায়! অথচ সময়ের প্রয়োজনে তা-ই করা হয়েছে, সবার আগে তো মানুষের জীবন।

এছাড়া পরে আরও যে কী করতে হতে পারে, আমরা এখনও তা জানি না, কল্পনার অতীত। বাংলা ভাষায় প্রচলিত একটি প্রবচন আছে- ‘যে জানে না উত্তর-পুব, তার মনে সদাই সুখ।’ করোনা ইতোমধ্যে সারা দুনিয়াকে তছনছ করে ফেলেছে আর আমরা এখনও প্রতিরোধ ও প্রস্তুতি নিয়ে বলতে গেলে গবেষণার পর্যায়েই হাবুডুবু খেয়ে চলেছি। প্রস্তুতি ও সমন্বয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও পারস্পরিক দোষাদুষিরও কোনো শেষ নেই। অথচ এখনই দরকার করোনা প্রতিরোধের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ পুনর্বাসন-পুনর্গঠনের আগাম প্রস্তুতি।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *