করোনাভাইরাসের দৌরাত্ম্য কোথায় গিয়ে থামবে, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এর প্রাণঘাতী চরিত্র অনুমান করা গেলেও পরিণতির শেষটা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। এটা শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়, উন্নত-অনুন্নত সারা বিশ্বেই এ এক স্মরণকালের ভয়াবহ বাস্তবতা। আক্রান্ত ২১২টি অঞ্চল ও দেশের সবাই যার যার অবস্থান ও সক্ষমতা অনুযায়ী এই মহামারী মোকাবেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের দেশের সরকারও হাত গুটিয়ে বসে নেই।
একদিকে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা, আরেকদিকে মানুষকে দু’মুঠো খাদ্যের জোগান দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার নিরন্তর চেষ্টা চলছে। সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও সচল রাখার চেষ্টায় ইতোমধ্যেই সরকারি তরফ থেকে প্রায় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা এসেছে। ২৭ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বলেছেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে কৃষি উৎপাদনকে সংহত করার ওপর জোর দিতে হবে, একখণ্ড জমিও যেন পতিত না থাকে।
উৎপাদনকে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এ তাগিদ যথার্থ। তবে কেন জানি না, আমাদের বেশির ভাগ উপলব্ধি এবং তা থেকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়টি অনেকটা শেয়ালের কাঁথা কেনার মতো। শীতের রাতে শেয়াল সারা রাত চিৎকার করে বলতে থাকে, রাত পোহালেই কাঁথা কিনব। কিন্তু সকালে যেই না সূর্য ওঠে আর ঠাণ্ডার প্রকোপ কমে যায়, তখন আর কাঁথা কেনার কথা মনে থাকে না। রাত হলে অবার…।
যখনই সংকট তৈরি হয়, তখনই বুদ্ধি মাথায় আসে, একটু দূরের কথা অনুমান করতে পারে না। কৃষি তথা কৃষকের প্রতি শুভদৃষ্টির অভাব আমাদের দীর্ঘদিনের। ‘কৃষক বাঁচাও’ একটি অতি পুরনো স্লোগান; কিন্তু তার সুরাহা আজও হয়নি। আশা করি, এ দুঃসময়ে কৃষির প্রয়োজনীয়তা সবার উপলব্ধিতে আসবে, পাশাপাশি কৃষকের প্রকৃত মূল্য অনুভব করতে আমরা সক্ষম হব।
অর্থনীতিতে কোন খাতের গুরুত্ব কতখানি, তা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। টমাস মান (Thomas Mun: 1561-1641) ও অ্যান্তোনিও সেরার (১৫৮০-১৬৫০) নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘বনিকবাদের’ (Mercantilism) ধারণায় রফতানি বাণিজ্যকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হতো। কোনো একটি রাষ্ট্রকে শক্তিশালী হতে হলে কৃষির পরিবর্তে বাণিজ্য ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে মাত্র ২২ বছরের জন্য (১৭৫৬-১৭৭৮) ফ্রান্সে ‘ফিজিওক্রাট’ নামে আরেকটি দলের আবির্ভাব ঘটে। ফ্রান্সিস কুনে (১৬৯৪-১৭৭৪) ও টারগট (১৭২৭-১৭৮১) ছিলেন এই মতবাদীদের স্থপতি। তাদের মতে, কৃষিই হল একমাত্র উৎপাদনশীল খাত। কৃষির বাইরে শিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারিং হল ‘বন্ধ্যা’ (Sterile)। একমাত্র কৃষিই পারে উদ্বৃত্ত তৈরি করতে। ১ কেজি ধান থেকে ৫০০ কেজি ধান উৎপাদন করা সম্ভব, যা আর কোনো খাতে সম্ভব নয়। যদি পরিমাণের কথা বিবেচনা করি, তাহলে ফিজিওক্র্যাটদের যুক্তি অকাট্য।
ক্লাসিক্যাল অর্থনীতি মতবাদের প্রবক্তা এডাম স্মিথ (১৭৭৩-১৭৯০) ডাক্তারি পেশা, বিচারকের কাজ কিংবা অভিনয়কে ‘অনুৎপাদনশীল’ বলে বিবেচনা করেছেন। তারই উত্তসূরি জেবি সে (১৭৬৭-১৮৩২) উৎপাদশীলতার ভিন্ন সংজ্ঞা দেন। তার মতে, যা মানুষের কাজে আসে তার সবই উৎপাদন বলে বিবেচনা করতে হবে।
ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র রোগীর কাজে লাগে, ভাত মানুষের পেটের ক্ষুধা মেটায়, গান মানুষের মনের খোরাক জোগায়; সুতরাং এর সবই উৎপাদনশীল। অর্থাৎ অর্থনীতির সার্বিক কর্মকাণ্ডের কোনোটিকেই আর ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। দুই বছর আগেও আমাদের জাতীয় বাজেটের দুটি অংশ ছিল ‘উন্নয়ন ব্যয়’ এবং ‘অনুন্নয়ন ব্যয়’। বছরখানেক হল নীতিনির্ধারকরা ‘অনুন্নয়ন’ শব্দটি তুলে দিয়ে ‘পরিচালন’ শব্দটি ব্যবহার করছেন।
এখানে শিল্প খাত বা সেবা খাতকে উপেক্ষা করে কৃষি খাতকে একমাত্র বিবেচিত খাত হিসেবে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। শিল্প মানুষের জীবনকে সহজ করে, আরামদায়ক করে, উৎপাদন ও পরিবহন ব্যবস্থাকে গতিশীল করে, উৎপাদনশীলতা বাড়ায় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কৃষি মানুষকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখে। করোনাভাইরাসের আক্রমণে মানুষ তাদের সব ধরনের ভোগ-বিলাস বাদ দিয়ে শুধু প্রাণে বাঁচতে চাইছে, তাই কৃষিভাবনা সরকারকে তাড়িত করছে। কৃষিতে উৎপাদনশীলতা ও পরিধি সম্প্রসারণের পাশাপাশি কৃষকের জীবনমান নিয়েও ভাবতে হবে।
যে কৃষক সারা জীবন আমাদের প্রাণরক্ষার জোগান দিয়ে যাচ্ছে তার সহায়সম্বল কী? একেবারেই সাদামাটা অর্থে বললে- লুঙ্গি, খালি গা, ঘাড়ে গামছা। এ দৃশ্য আজকের নয়। আমরা যখন ভারতবর্ষের অংশ ছিলাম, প্রকৃত কৃষকের ঘাড়ে গামছাটাই ছিল একমাত্র সম্বল। ভারত ভেঙে পাকিস্তান হল, তখনও একই চিত্র। পাকিস্তানি শোষণ ব্যবস্থাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হল। আজও আমাদের কৃষকের ঘাড়ে সেই চির পরিচিত গামছা।
কৃষি খাতের মধ্যস্বত্বভোগীরা পাঁচতারা হোটেলে নাশতা খাওয়ার অভ্যাস করে ফেলেছে, আর প্রকৃত উৎপাদনকারী কৃষক সকালে পান্তাভাতও জোগাতে অক্ষম। অথচ এই কৃষক কী না করেছে, কী না করছে আমাদের জন্য? স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ৭ কোটি ৮০ লাখ মানুষের জন্য এ দেশের কৃষক ১০ মিলিয়ন টন চাল উৎপাদন করত। আজ লোকসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এ অবস্থায় তারা হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে চালের উৎপাদন ৩৬ মিলিয়ন টনে পৌঁছে দিয়েছে।
বিনিময়ে ওই ঘাড়ের গামছা ছাড়া তাদের আর কী দিতে পেরেছি? এতকিছুর পরও এদেশের কৃষকরা সারের জন্য রাস্তায় গুলি খেয়ে মরে; ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে জমিতেই ফসল পুড়িয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়েই বলেছেন, আমাদের এক ছটাক জমিও চাষের বাইরে রাখা যাবে না। তার এ বক্তব্যকে স্বাগত জানাই। কিন্তু আমার নিবেদন, উৎপাদনের ন্যায্য দাম যেন নিশ্চিত করা হয়, উৎপাদন করার পর কৃষক যেন নিজের গায়ে আগুন জ্বেলে না দেন।
এখন বোরো ধানের মৌসুম চলছে। শ্রম-সংকট থেকে শুরু করে শত সীমাবদ্ধতার ভেতরও কৃষক ক্ষেতের ধান গোলায় তুলতে শুরু করেছে। আমাদের সবচেয়ে বড় ধানের জোগান আসে বোরো থেকে। তারপর আমন আর সর্বনিম্ন আসে আউস থেকে। মোট ২৯ মিলিয়ন একর ধানিজমির ৪১ শতাংশ অর্থাৎ ১২ মিলিয়ন একরে বোরো চাষ হয়। উৎপাদন হয় প্রায় ১৯ মিলিয়ন টন ধান, যা মোট উৎপাদিত ধানের প্রায় ৫২ শতাংশ। সরকার ইতোমধ্যেই ৬ লাখ টন ধান এবং ১১ লাখ টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আরও ২ লাখ টন বাড়ানোর কথাও শোনা যাচ্ছে। তারপরও সরকারিভাবে যে ধান কেনা হবে তা মোট উৎপাদিত ধানের ৯ শতাংশের বেশি নয়। আমরা দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি, এই দুর্যোগের সময়ে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে মুক্তবাজার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখা কিংবা নির্ভরশীল থাকা সমীচীন হবে না। যতটা সম্ভব খাদ্য বাজারকে সরকারের নিয়ন্ত্রণেই রাখতে হবে। সে কারণে ধান কেনা ও সংরক্ষণের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। প্রয়োজন হলে অস্থায়ী গুদামের ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্তু ধানের দাম কত নির্ধারণ করা উচিত? বাস্তব উদাহরণ নেয়া যাক। এক বিঘা জমিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধান উৎপাদনে দৃশ্যমান খরচ (Explicit cost) ১৩ হাজার ৫০০ টাকা; এক বিঘায় গড়ে ১৯ মণ ধান হয়। উৎপাদনে মণপ্রতি খরচ ৭১০ টাকা। সরকার এবারে ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ১০০০ টাকা। যারা হিসাব বিজ্ঞানের ছাত্র তারা বলবেন এতে করে কৃষক মণপ্রতি ২৯০ টাকা মুনাফা পাবেন। কিন্তু অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি এর সঙ্গে একমত নই। কারণ খরচের খাতায় কৃষকের নিজের এবং তার পরিবারের সদস্যদের মজুরিটা ধরা হয়নি, যাকে বলে অদৃশ্যমান খরচ (Implicit cost)।
তিন মাসে এর পরিমাণ ন্যূনতম ১৫ হাজার টাকা। তাহলে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান মিলে মোট খরচ দাঁড়ায় বিঘাপ্রতি ২৮ হাজার ৫০০ টাকা বা মণপ্রতি ১৫০০ টাকা। সেখানে সরকারনির্ধারিত ধানের দাম প্রকৃত অর্থে ৫০০ টাকা কম। আমরা আরেকটু বেশি দাম দাবি করতে পারি। তা না হলে আমাদের কৃষককে তথা কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। এরপরও যা নিশ্চিত করতে হবে তা হল সরকার নির্ধারিত দামে যেন কৃষক ধান বিক্রি করতে পারে। এখানে অনেক দলীয় রাজনীতি ও দালালের খেলা চলে। অবাঞ্ছিত কারণেই কৃষক কয়েক বছর ধরেই নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
প্রকৃত কৃষক আর ভূমিমালিক সমার্থক নয়। এখন বেশির ভাগ জমিই ‘পত্তনি’ ব্যবস্থায় চাষাবাদ হয়। বিঘাপ্রতি বছরে গড়ে ৫ হাজার টাকা ভূমিমালিককে দিতে হয়। এটা উৎপাদন হলেও দিতে হবে, না হলেও দিতে হবে। তাই সরকারি প্রণোদনা সরাসরি প্রকৃত কৃষকের হাতে তুলে দেয়াটা জরুরি। আমরা যেহেতেু বুঝতেই পারছি যে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি এবং এও নিশ্চিত হয়েছি যে, এই অনিশ্চয়তায় প্রাণে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে কৃষি, তাই কৃষককে রক্ষা করতে যেন ভুল না করি।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়