শুভংকর কর্মকার
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত তৈরি পোশাকশিল্প। সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানে গত চার দশক ধরে বড় অবদান রেখে চলছে খাতটি। নারীর ক্ষমতায়নেও অন্য যে কোনো খাতের চেয়ে পোশাকশিল্প যোজন যোজন এগিয়ে। সরকারের বহুমুখী সুযোগ-সুবিধা, সস্তা শ্রম আর উদ্যোক্তাদের কঠোর পরিশ্রমের কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশে^ বাংলাদেশের দ্বিতীয় অবস্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে।

সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বড় ধরনের ধাক্কা খায় বাংলাদেশের পোশাকশিল্প। তবে গত সাত বছরে নানামুখী উদ্যোগের কারণে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়ায়। তবে চলমান করোনাভাইরাস মহামারীতে নতুন করে আবার বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের খাতটি। মার্চে যখন করোনা ভয়াবহ আকার ধারন করে তখন একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ার পর খাতটির অনেক উদ্যোক্তাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তবে অল্প দিনের ব্যবধানে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। রপ্তানি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তবে অবস্থার সাময়িক উন্নতি হলেও করোনা পরবর্তী সময়ে পোশাক রপ্তানির ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সে জন্য উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উদ্যোগ লাগবে। মোদ্দা কথা, দ্রুত আমাদের পরিবর্তী পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া চেষ্টা করতে হবে।

আমাদের আজকের প্রতিবেদন করোনা পরবর্তী পোশাক খাতের চ্যালেঞ্জ ও উত্তোরণের বিষয়ে আলোচনা করব। তবে তার আগে পোশাক খাতের প্রাথমিক বিষয়ে কিছু তথ্য জেনে নেব। যাতে করে পোশাক খাত নিয়ে একটি পূর্নাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়।

পোশাকশিল্পের শুরুর গল্প
দেশ গার্মেন্টসের হাত ধরে ১৯৭৮ পোশাক রপ্তানির যাত্রা শুরু। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে মোহাম্মদ নুরুল কাদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেশ গার্মেন্টস নামের কারখানাটি। তখন বাংলাদেশে শ্রমিক-মালিক কারোরই তৈরি পোশাক কারখানার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই শুরুতে গাঁটছড়া বেধেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান দাইয়ু এর সঙ্গে।

কাজ শেখানোর জন্য দেশ গার্মেন্টসের ১৩০ জনকে সে সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন নূরুল কাদের। তাদের মধ্যে শ্রমিক থেকে শুরু করে কর্মকর্তারাও ছিলেন। যাঁদের অনেকেই পরে নিজেরাই পোশাক কারখানার মালিক হন। ফলে দেশ গার্মেন্টসর মোহাম্মদ নুরুল কাদেরকে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের পথিকৃত বললে বাড়াবাড়ি কিছু হবে না। দেশের প্রথম পোশাক কারখানা হিসেবে ব্যাক টু ব্যাক এলসি, বন্ডেড ওয়্যার হাউজ থেকে সবকিছুর প্রবক্তা ছিল দেশ গার্মেন্টস।

নুরুল কাদেরের দেখান পথ ধরে বাংলাদেশে একের পর এক পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে। নব্বইয়ের দশকের বিভিন্ন সময় নিজেদের বাসা বাড়ী কিংবা ভাড়া করা ছোট্ট কারখানা দিয়ে যাত্রা শুরু করা উদ্যোক্তাদের অনেকেই বর্তমানে অনেকগুলো পোশাক কারখানার মালিক। অনেকে আবার পোশাক কারখানা দিয়ে শুরু করে অন্যান্য খাতেও ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়েছেন। এ পর্যায়ে আমরা দুলাল ব্রাদার্স বা ডিবিএল গ্রুপের সফলতার কথা একটুখানি বলতে পারি।

বাবার দেওয়া ৬০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে নিজেদের পুরোনো বাড়িকে ছোট্ট কারখানায় রূপান্তর করলেন চার ভাই। কিনলেন ৩৭টি সেলাই মেশিন। কয়েক দিন সকাল-বিকেল আশপাশের বিভিন্ন কারখানা ফটকে দাঁড়িয়ে জোগাড় করলেন শতাধিক শ্রমিক। অন্য কারখানা থেকে ঠিকায় কাজ (সাবকন্ট্রাক্টটিং) আনলেন। পোশাক তৈরির পর ডেলিভারি হলো। বছর দুয়েক এভাবেই চলল। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করেও দুই বছরে লাভের মুখ দেখলেন না চার ভাই।

মুনাফা না হলেও পণ্যের মান ও সময়মতো তা বুঝিয়ে দিয়ে অল্প দিনেই দু-চারজন ক্রেতার সুনজরে পড়লেন চার ভাই। ফলে ১৯৯৩ সালে যুক্তরাজ্যের এক ক্রেতার কাছ থেকে সরাসরি ক্রয়াদেশ পেলেন তাঁরা। তিন হাজার পিস পলো শার্ট। তারপর চার ভাইকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২৯ বছরের ব্যবধানে পোশাকশিল্পের শীর্ষ রপ্তানিকারকদের অন্যতম তাঁরা।

১৯৯১ সালে ঢাকার ১০২ গ্রিন রোডে ছোট কারখানা দিয়ে শুরু করা সেই প্রতিষ্ঠানটি আজকের দুলাল ডিবিএল গ্রুপ। আর সেই চার ভাই হলেন আবদুল ওয়াহেদ, এম এ জব্বার, এম এ রহিম ও এম এ কাদের। তাঁরা যথাক্রমে ডিবিএল গ্রুপের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), ভাইস চেয়ারম্যান ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি)।

পোশাক দিয়ে শুরু হলেও গত ২৯ বছরের ব্যবসায় সিরামিক টাইলস, তথ্য প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ ও ড্রেজিং ব্যবসায় নাম লিখিয়েছে ডিবিএল। শিগগিরই তারা দেশে ওষুধ ব্যবসায়ও আসছে। সব মিলিয়ে ডিবিএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বর্তমানে ২৪টি। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ৩৬ হাজার কর্মী। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্রুপের বার্ষিক লেনদেন ছিল প্রায় ৬০ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার সমান। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ব্যবসা থেকেই এসেছে ৯০ শতাংশ অর্থ। সব মিলিয়ে গ্রুপটির বিনিয়োগের পরিমাণ ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে তাদের সদস্য কারখানার সংখ্যা ৪ হাজার ৬২১। এসব কারখানায় কাজ করেন ৪৪ লাখ শ্রমিক। কয়েকদিন আগেও সংগঠনটির নেতারা এসব তথ্য দিলেও বর্তমানে তারা বলছেন, গত জুলাই মাসে ১ হাজার ৯২৬টি পোশাক কারখানা সরাসরি পোশাক রপ্তানি করছে। এসব কারখানায় কাজ করেন ২০-২২ লাখ শ্রমিক। অন্যদিকে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সদস্য কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ২৮৩। তবে সংগঠনটির নেতারা গত কয়েক মাস ধরে বলছেন, সদস্যের মধ্যে সরাসরি রপ্তানি করে এমন কারখানার সংখ্যা ৮৩৮। বাকি কারখানার অধিকাংশই বন্ধ। কারখানায় কর্মরত শ্রমিক সংখ্যা সঠিক করে বলতে পারে না বিকেএমইএ। ফলে পোশাকশিল্পে প্রকৃতপক্ষে কত কারখানা রয়েছে এবং সেখানে কত শ্রমিক কাজ করেন তার সঠিক সংখ্যা নিয়ে ধোয়াশা রয়েছে।

সরকারের সুুযোগ-সুবিধায় বেড়ে ওঠা
অন্যান্য দেশের তুলনায় সস্তা শ্রম, কোটা পাশাপাশি সরকারী সুবিধা অর্থাৎ শুল্কমুক্ত আমদানি, ২৫ শতাংশ নগদ সহায়তা, ব্যাক-টু-ব্যাক এল সি, বন্ডেডওয়্যার হাউজ সুবিধা ও সংরক্ষিত বাজারের আকর্ষণে অনেকে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই পোশাক ব্যবসায় নেমে পড়েন অনেক উদ্যোক্তা। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের আগে শুরু করলেও আশির দশকের শুরুতে গৃহযুদ্ধের কারণে পিছিয়ে পড়ে। তখন উন্নত দেশের ক্রেতারা বাংলাদেশকেই ভালো বিকল্প হিসেবে বেছে নেয়। ফলে তরতর করে বাড়তে থাকে পোশাক রপ্তানি।

পোশাক খাতকে প্রথম বড় সুবিধা দেয় এইচ এম এরশাদ সরকার, ১৯৮২ সালে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) নির্দেশিত কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচির অধীনে রপ্তানিমুখী কৌশল গ্রহণ করা হয়। এতে রাষ্ট্রীয় খাত সংকোচনের মাধ্যমে ব্যক্তিখাতকে উৎসাহিত করে এবং রপ্তানিমুখী শিল্প খাতকে প্রাধান্য নিয়ে করা হয় শিল্পনীতি। চালু করা হয় ডিউটি ড্র ব্যাক (ডেডো) ব্যবস্থা। বলা হয়, উদ্যোক্তারা কাঁচামাল আমদানির সময় শুল্ক দিলেও রপ্তানি করার পর তা ফেরত পাবেন। কিন্তু বিলম্ব হওয়া ও দুর্নীতির সুযোগ থাকায় পরে এই পদ্ধতি বন্ধ করে চালু করা হয় বন্ড সুবিধা। এতে পোশাক মালিকদের বিনা শুল্কে পোশাক তৈরির কাঁচামাল আমদানির দ্বার খুলে যায়।

এরশাদ সরকারের শেষের দিকে দেওয়া হয় আরেকটি বড় সুবিধা। স্থানীয় ঋণপত্র বা ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্রের (এলসি) ব্যবস্থা। ফলে কাঁচামাল আমদানিতে উদ্যোক্তাদের কোনো অর্থ ব্যয়ই আর করতে হয়নি। উদ্যোক্তাদের তখন কেবল রপ্তানির আদেশ আনতে হতো। আর টাকা-পয়সার দায়িত্ব ব্যাংকের। এখনো পোশাকমালিকদের অনেকেই মনে করেন, খাতটির ব্যাপক অগ্রগতির পেছনে বন্ড-সুবিধা এবং ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির ভূমিকাই প্রধান।

সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬-২০০১ সময়ের আওয়ামী লীগ সরকার পোশাক খাতকে আরেকটি বড় সুবিধা দেয়। বস্ত্র ও পোশাক খাতকে ১৯৯৭ সালে ২৫ শতাংশ নগদ সুবিধা দেওয়া হয়। যদিও বিএনপি সরকার ২০০২-০৩ অর্থবছরে তা কিছুটা কমিয়ে ১৫ শতাংশ করে। এখনো নগদ সহায়তা আছে। রয়েছে নিত্যনতুন সুবিধাও। সুযোগ সুবিধা সর্বশেষ উদাহরণ করোনা শুরু হওয়ার পর প্রথম যে প্রণোদনা প্যাকেজ (৫ হাজার কোটি টাকা) ঘোষণা করা হয় সেটি পোশাকশিল্পকে মাথায় রেখেই।

রপ্তানি বেড়েছে ৮৮৭ গুণ
স্বাধীনতার সময় যে পোশাক খাতের কোনো অস্থিত্বই ছিলো না, সেই খাতটি এখন দেশের মোট পণ্য রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের যোগান দিচ্ছে। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ১৫ লাখ ডলার। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৭৯৫ কোটি ডলার। তার মানে ৩৭ বছরে রপ্তানি বেড়েছে ৮৮৭ গুণ।

একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বড় বাজারগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম ইত্যাদি। জোট হিসেবে ধরলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) হচ্ছে বাংলাদেশী পোশাকের বড় গন্তব্য। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইইউতে মোট পোশাক রপ্তানির ১ হাজার ৭১৪ কোটি ডলার বা ৬১ দশমিক ৩৫ শতাংশ রপ্তানি হয়েছে। তারপর সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রে ৫১৪ কোটি ডলার বা ১৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ রপ্তানি হয়েছে। ইইউতে রপ্তানি বেশি হওয়ার বড় কারণ বাজারটিতে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে। সে জন্য ইইউর ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য নিজেদের দেশে নিতে পারে।

একসময় বাংলাদেশি পোশাকের মূল বাজার ছিল ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। তবে দেরীতে হলেও প্রচলতি এই তিন বাজারের বাইরেও নতুন বা অপ্রচলিত বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়ছে। যদিও সেটিকে প্রত্যাশার তুলনায় এখনও কমই বলতে হবে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট পোশাক রপ্তানির ১৭ দশমিক ১০ শতাংশ বা ৪৭৮ কোটি ডলারের পোশাক নতুন বা অপ্রচলতি বাজারে গিয়েছে। নতুন বাজারের মধ্যে জাপানে ৯৬ কোটি ডলার, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০ কোটি ডলার, রাশিয়ায় ৪৪ কোটি ডলার, ভারতে ৪২ কোটি ডলার, চীনে ৩২ কোটি ডলার, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে।

বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা মোটাদাগে ৫ ধরনের পোশাকই বেশি রপ্তানি করেন। সেগুলো হচ্ছে- শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, টিশার্ট ও সোয়েটার। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৭৯৫ কোটি ডলারের মধ্যে ৭১ শতাংশ বা ১ হাজার ৯৯৩ কোটি ডলার এসেছে এই পাঁচ পোশাকে। তার মধ্যে ১৭৮ কোটি ডলারের শার্ট, ৫৪৪ কোটি ডলারের ট্রাউজার, ৩৫১ কোটি ডলারের জ্যাকেট, ৫৬১ কোটি ডলারের টি শার্ট ও ৩৫৯ কোটি ডলারের সোয়েটার রপ্তানি হয়েছে।

রানা প্লাজার ধাক্কা ও ঘুরে দাঁড়ানো
বাংলাদেশের পোশাক খাতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছে রানা প্লাজা ধস (করোনা যেহেতু এখন চলমান সেহেতু এই মহামারীর প্রভাব কতটা সুদুরপ্রসারী হবে এখনই বলা যাচ্ছে না)। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল পৌনে নয়টায় সাভারে নয়তলা রানা প্লাজা ধসে পড়ে। এ ঘটনায় ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক মারা যান। আহত হন হাজার খানেক শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে অঙ্গ হারান ২৭ জন।

রানা প্লাজা ধসের পর বিশ^ব্যাপী বাংলাদেশী পোশাক বর্জনের রব ওঠে। পোশাক কারখানাগুলো নিরাপদ নয় সেই অভিযোগে অনেক বড় বড় ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনা বন্ধ করে দেয়। তখন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের উদ্যোগে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ইউরোপী ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স গঠিত হয়। তাদের অধীনে ২ হাজারের বেশি কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। অনেক কারখানা কর্মপরিবেশ উন্নত করতে ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগ করে। কারখানার কর্মপরিবেশের এই উন্নতিকে পুঁজি করে গত ছয় বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৯১০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৭৭ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পায়।

অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের সদস্য ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাজ করে না এমন কারখানার সংস্কারকাজের জন্য জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) অধীনে কাজ শুরু হয়। পরে আইএলওর নেতৃত্বে এবং কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) তত্ত্বাবধানে সংস্কারকাজ তদারকিতে গঠিত হয় সংশোধন সমন্বয় সেল (আরসিসি)। তবে শুরুতে কিছুটা গতি থাকলেও বর্তমানে আরসিসির কাজ চলছে খুঁড়িয়ে। এনটিএপির অধীনে থাকা কারখানাগুলোর সংস্কার কাজ অর্ধেকও হয়নি। বারবার তাগিদ দিয়েও কারখানা মালিকদের সংস্কারকাজ শেষ করানো যায়নি। ফলে ৬০০-৭০০ কারখানা পুরোপুরি নিরাপদ করা যায়নি।

এদিকে পাঁচ বছর কাজ করার পর অ্যালায়েন্স তাদের কার্যক্রম গুটিয়েছে। অন্যদিকে চলতি বছর অ্যাকর্ডও বিদায় নিয়েছে। সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর উদ্যোগে আরএমজি সাসটেইনিবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি) গঠন করেছে। তবে করোনার কারণে সেটির কার্যক্রম খুব একটি আগায় নিয়ে গত কয়েক মাসে। এই মহামারীর কারণে পোশাক খাত নতুন এক সংকটের মধ্যে পড়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে কারখানার সংস্কারকাজ কতটুকু এগোবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে। পুরোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্যোক্তারা কতটা নজর দিবেন তা নিয়ে সংশয় আছে। তার মধ্যে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স তো নেই।

পরিবেশবান্ধব কারখানার শীর্ষে
রানা প্লাজা পোশাক খাতকে যেমন ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল তেমনি এই মর্মান্তিক ঘটনার পর বেশ কয়েকটি দুর্দান্ত কাজ হয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়তে উদ্যোক্তাদের মনোযোগী হওয়া। যদিও তার আগেই দেশে পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে উঠেছিল।

পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তা সাজ্জাদুর রহমান মৃধার হাত ধরে ২০১২ সালে প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানার যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে। পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে তিনি স্থাপন করেন ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। তাঁর দেখানো পথ ধরে ৯৪টি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা ও বস্ত্রকল হয়েছে। পিছিয়ে নেই অন্যরাও। শিপইয়ার্ড, জুতা, ও ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাণেও আছে পরিবেশবান্ধব কারখানা। বাণিজ্যিক ভবনও হচ্ছে। তবে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব পোশাক ও বস্ত্রকল রয়েছে।

দেশে এক শর বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা হলেও সেগুলো কিন্তু যেনতেন মানের না। উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিশ্বে জিনস বা ডেনিম কাপড় উৎপাদন করার প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ভালুকায় এনভয় টেক্সটাইল। নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেডে রেমি হোল্ডিংস, সারা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা। আবার নারায়ণগঞ্জের উত্তর নরসিংহপুরের প্লামি ফ্যাশনস, নিট পোশাক তৈরি করা বিশ্বের প্রথম ও শীর্ষ নম্বর পাওয়া পরিবেশবান্ধব কারখানা।

সারা বিশ্বের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। তারা ‘লিড’ নামে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। লিডের পূর্ণাঙ্গ রূপ লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। সনদটি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়। ভবন নির্মাণ শেষ হলে কিংবা পুরোনো ভবন সংস্কার করেও ইউএসজিবিসির সনদের জন্য আবেদন করা যায়।

১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউএসজিবিসি। সংস্থাটির অধীনে কলকারখানার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভবন, স্কুল, হাসপাতাল, বাড়ি, বিক্রয়কেন্দ্র, প্রার্থনাকেন্দ্র ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব স্থাপনা হিসেবে গড়ে তোলা যায়। বর্তমানে বিশ্বের ১৬৭ দেশে লিড সনদ পাওয়া স্থাপনার সংখ্যা ৯২ হাজারের বেশি। লিড সনদের জন্য ৯টি শর্ত পরিপালনে মোট ১১০ পয়েন্ট আছে। এর মধ্যে ৮০ পয়েন্টের ওপরে হলে ‘লিড প্লাটিনাম’, ৬০-৭৯ হলে ‘লিড গোল্ড’, ৫০-৫৯ হলে ‘লিড সিলভার’ এবং ৪০-৪৯ হলে ‘লিড সার্টিফায়েড’ সনদ মেলে।

বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব স্থাপনাগুলোর একটি ছাড়া সবগুলো ইউএসজিবিসির অধীনে সনদ পেয়েছে। সংস্থাটির ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ১০৭টি স্থাপনা লিড সনদ পেয়েছে। তার মধ্যে লিড প্লাটিনাম ২৮টি, গোল্ড ৬৬টি, সিলভার ১১টি এবং ২টি সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। ১০৭টি পরিবেশবান্ধব স্থাপনার মধ্যে ৯৫টিই পোশাক ও বস্ত্র খাতের কারখানা। বর্তমানে ৫০০-এর বেশি প্রকল্প পরিবেশবান্ধব হতে ইউএসজিবিসির অধীনে কাজ চলছে। তা ছাড়া দেশের একমাত্র পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙার ইয়ার্ড পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে পিএইচপি গ্রুপের এই ইয়ার্ড ২০১৭ সালে হংকং ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব শিপ ইয়ার্ডের মর্যাদা পায়।

চট্টগ্রামের প্যাসিফিক জিনসের কারখানা লিড গোল্ড সনদ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার মান উন্নয়নের তাগিদ ও পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা পুরোনো কারখানাকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলেছি। অনেক উদ্যোক্তাই পরিবেশবান্ধব কারখানা করছেন। সে জন্যই বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে আমাদের কারখানা এখন অনেক বেশি নিরাপদ।’

পোশাক রপ্তানিতে করোনার কোপ
করোনা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়লে গত মার্চে ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে ইউরোপ-আমেরিকায় লকডাউন জারি করা হয়। তাতে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। বিক্রি না থাকায় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলো একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করা শুরু করে। দিন দিন সেটি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সেই সঙ্গে নতুন ক্রয়াদেশ আসাও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান উদ্যোক্তারা।

বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, করোনায় ৩১৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ প্রাথমিকভাবে বাতিল ও স্থগিত হয়েছিল। তার মধ্যে প্রাইমার্ক ৩৩ কোটি, ইন্ডিটেক্স ৮ কোটি ৭০, বেস্টসেলার ৮ কোটি ৩০ লাখ, মাদারকেয়ার ৫ কোটি ৬০ লাখ, কোহলস ৫ কোটি ৪০ লাখ, গ্যাপ ৩ কোটি ৮০ লাখ, জেসি পেনি সাড়ে তিন কোটি, ওয়ালমার্ট ১ কোটি ৯০ লাখ, ডেবেনহাম ১ কোটি ৮০ লাখ ও রালফ লরেন ১ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করে (হিসাবটি আনুমানিক)। তবে পরবর্তীতে নানামুখী চাপের কারণে অধিকাংশ ক্রেতাই পণ্য নিতে সম্মত হয়। অবশ্য অর্থ পরিশোধে ছয় মাস পর্যন্ত সময় চায় অনেকে।

এদিকে বাংলাদেশেও ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে মার্চের শেষ সপ্তাহে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। তারপর মাসখানেক অধিকাংশ পোশাক কারখানা বন্ধ থাকে। তাতে এপ্রিলে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনি¤œ। পরের মাসে রপ্তানি হয় ১২৩ কোটি ডলারের পোশাক। তবে জুনে সেটি বেড়ে ২২৫ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপরও বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৭৯৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা তার আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৬১৮ কোটি ডলার কম।

গত জুলাই মাসেই উদ্যোক্তারা জানান, গতবারের তুলনায় বর্তমানে ৭০-৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ আসছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে সাহস জুগাচ্ছে। অনেকগুলো বড় ব্র্যান্ড স্থগিত ও বাতিল হওয়া পণ্য নিতে শুরু করায় পোশাক রপ্তানি গত জুনে বেশ খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে বিশ^ব্যাপী করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস ও টিকা আবিস্কার না হওয়ায় এক ধরণের অনিশ্চয়তা থাকবে।

মার্চে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সরকার রপ্তানিমুখী শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করে। সেই তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানা মালিক ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ নিয়ে তিন মাসের মজুরি দিয়েছেন। পরে সাড়ে চার শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে জুলাই মাসের মুজরিও দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। এ ক্ষেত্রে প্রথম তিন মাসে ৭ শতাংশ ও পরের এক মাসে সাড়ে চার শতাংশ সুদ ভর্তুকি দিয়েছে সরকার।

পোশাকশিল্পের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা স্বীকার করেছেন মজুরি পরিশোধে সরকারের ঋণ সহায়তা ব্যবসায় টিকে থাকতে তাঁদের ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে। সহায়তা না পেলে অনেকেই ব্যবসা থেকে নিশ্চিতভাবে হারিয়ে যেতেন। অবশ্য ঋণ সহায়তা পেলেও উদ্যোক্তাদের একটি অংশ শ্রমিকদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করছেন। লকডাউন শুরু হওয়ার পরপরই শ্রমিক ছাঁটাই করেন অনেকে। সবমিলিয়ে দুই তিন মাসে বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হোন। গত এপ্রিলে কারখানা বন্ধকালীন সময়ে শ্রমিকদের ৬৫ শতাংশ মজুরি দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। এমনকি শ্রমিকের ঈদ বোনাসেও হাত দিয়েছে অধিকাংশ মালিক। মানে অর্ধেক ঈদ বোনাস দিয়েছেন।

আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ
করোনার প্রথম ধাক্কা কিছুটা সামলে নিয়ে পুরো পৃথিবী নতুন স্বাভাবিক বা নিউ নরমাল সময়ে প্রবেশ করেছে। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, করোনা পরবর্তী দিনে পোশাক খাত আর আগের মতো থাকবে না। তো আগামী দিনে চ্যালেঞ্জ কি? এখনই চ্যালেঞ্জগুলো পরিষ্কারভাবে বলা যাবে না। তবে কিছুটা আঁচ হয়তো করা যাচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, দিন যত গড়াবে চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো তত পরিষ্কার হবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা কয়েকজন উদ্যোক্তা ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। আসুন তাদের কথা শুনি।

চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, করোনা পরবর্তী সময়ে ক্রয়াদেশ স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা কমবে। বর্তমানে আমরা অনেকে একেকটি ডিজাইনের (নকশা) ১ থেকে ২ লাখ পিছ পোশাকের ক্রয়াদেশ পাই। ভবিষ্যতে একটি পরিমাণে ক্রয়াদেশ মিলবে না। সে জন্য ছোট কোয়ানটিটির (পরিমাণ) ক্রয়াদেশ করার মানসিক প্রস্ততি নিতে হবে। দ্রুত পণ্য পাঠানোর দিকে আমাদের অবশ্যই এগোতে হবে। কারণ ক্রেতারা পণ্য পেতে আগের মতো আর চার-পাঁচ মাস আগে অর্থলগ্নি করবেন না। তাদের মানসিকতা পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমাদের অনলাইনে জোর দিতে হবে। এখানে অনেক সম্ভাবনা থাকলেও তবে কেউ নজর দিচ্ছে না।

করোনার শুরুতে ক্রেতারা ইচ্ছামতো ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করেছেন। ফলে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পেমেন্ট টামর্স বা অর্থ পরিশোধের শর্তাবলীতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন তরুণ উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এলসির পরিবর্তে ২০১৪ সাল থেকে আমরা অনেকেই চুক্তিতে ক্রয়াদেশ নিয়ে থাকি। সে জন্য চুক্তি ভঙ্গ করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ কম থাকে। সেই চুক্তির শর্তাবলী সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে নির্দিষ্ট করা দরকার।’

হঠাৎ আসা দুর্যোগ মোকাবিলায় কারখানাগুলোর জন্য বীমা সুবিধার আওতায় আনা দরকার বলে মনে করেন ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন। তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে সরকার বা বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ থেকে ব্যবসা করার ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। কারণ সস্তা পোশাক কিনতে দুনিয়ার ছোটখাটো অনেক ক্রেতা বাংলাদেশে আসেন। তাদের আর্থিক সক্ষমতার যাচাইবাছাই করে তাদের ছাড়পত্র দেওয়া দরকার। অন্যথায় ছোটখাট দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় তারা অর্থ পরিশোধ না করে আমাদের উদ্যোক্তাদের বিপদে ফেলবে। মূলত ভূঁইফোড় ক্রেতাদের হাত থেকে বাঁচাতে এমন উদ্যোগ দরকার।

নারায়ণগঞ্জের পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডের বেশি পরিমাণের ক্রয়াদেশ থাকবে। তবে অনেক ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কমে যাবে। ফলে একসঙ্গে অনেক স্টাইলের পণ্য করার জন্য দক্ষ হতে হবে। এ ছাড়া কমপ্লায়েন্সের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জোর দিবে। সে জন্য ব্যয় বাড়তে পারে।

ফজলুল হক বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি। তিনি আরও বলেন, করোনা পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রচলিত বাজারের বাইরে অন্য বাজারেও মনোযোগী হতে হবে। নিত্য নতুন পণ্য করতে হবে। অনলাইনে পণ্য বিক্রির দিকে মনোযোগী হতে হবে। এই দিকে আমাদের উদ্যোক্তাদের মনোযোগ একেবারেই কম। প্রয়োজনে কয়েকজন উদ্যোগ মিলেও অনলাইনে বিনিয়োগ করা যায়। সেক্ষেত্রে ছোট-মাঝারি উদ্যোক্তারা পথের সন্ধান পাবেন।

বাংলাদেশি পোশাকের অন্যতম বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম। সুইডেনভিত্তিক এই ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের পোশাক কিনে থাকে। সেই হিসেবে ১০ শতাংশ বাংলাদেশী পোশাকের ক্রেতা হচ্ছে এইচঅ্যান্ডএম।

এইচঅ্যান্ডএমের বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইথিওপিয়ার প্রধান জিয়াউর রহমান বলেন, ‘গত মে ও জুন মাসে আমরা বাংলাদেশে ৫০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ দিয়েছি। আমাদের ৩০০ সরবরাহকারী কারখানা সবাই ক্রয়াদেশ পেয়েছে। এইচঅ্যান্ডএমের ক্রয়াদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য প্রতিযোগী দেশের তুলনার বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। চীন ও তুরস্ক থেকে যেসব ক্রয়াদেশ সরছে তার একটি অংশ বাংলাদেশে আসছে। কারণ বাংলাদেশে উৎপাদন উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম। তাছাড়া বাংলাদেশের সরবরাহকারী বেশ ম্যাচুরেট।’

উৎপাদনশীল বৃদ্ধি ও পণ্যে বৈচিত্র্য আনাই আগামী দিনে টিকে থাকার মূল অস্ত্র হবে মনে করেন এইচঅ্যান্ডএমের বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইথিওপিয়ার প্রধান জিয়াউর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৭২ শতাংশ আসে মাত্র পাঁচ ধরনের পণ্যে। এই জায়গায় অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে।

বাংলাদেশি পোশাকের আরেক বড় ক্রেতা যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্র্যান্ড মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার (এমঅ্যান্ডএস)। ব্র্যান্ডটির ১ হাজার ৪৬৩ বিক্রয়কেন্দ্রে গত বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের পোশাক গিয়েছে। বর্তমানে এমঅ্যান্ডএসের পোশাক তৈরি করে দেশের ৫৫ জন সরবরাহকারী। কারখানার সংখ্যা ৮৩।

এমঅ্যান্ডএসের বাংলাদেশ প্রধান স্বপ্না ভৌমিক গতকাল বলেন, করোনায় আমরা কাজের ধরণ বদলে ফেলেছি। বিক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি যে পরিমাণে হচ্ছে সেই পরিমাণে ক্রয়াদেশ দিচ্ছি। নতুন ক্রয়াদেশের বেলায় আট সপ্তাহের বেশি সময় দিচ্ছি না। দ্রুত সরবরাহ করতে স্থানীয়ভাবে পোশাকের অনুমোদন দিতে শুরু করেছি আমরা। সেইসঙ্গে চীন থেকে কৃত্রিম তন্তুর সুতা আমদানি করে দেশেই কাপড় উৎপাদনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, উদ্যোক্তারা বর্তমান চ্যালেঞ্জের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিচ্ছেন। ফলে শিগগিরই বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়াবে।

স্বপ্না ভৌমিক আশার কথা শুনালে করোনার ডামাডোলে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় অবস্থান অনেক টালমাটাল হয়ে পড়েছে। ঘাড়ের ওপর নিশ^াস ফেলছে ভিয়েতনাম। বিজিএমইএ বলছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) বাংলাদেশ ৯৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। তার বিপরীতে ভিয়েতনাম রপ্তানি করেছে ১ হাজার ৫০ কোটি ৯১ ডলারের পোশাক। তার মানে পাঁচ মাসে বাংলাদেশের চেয়ে ৮২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি বেশি করেছে ভিয়েতনাম। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ এখনো পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয়।

পোশাকশিল্পের প্রতিষ্ঠান ভিয়েলাটেক্স গ্রুুপের চেয়ারম্যান কে এম রেজাউল হাসনাত বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই চীনের বড় বড় পোশাক কারখানা ভিয়েতনামে বিনিয়োগ শুরু করে। বর্তমানে ভিয়েতনামে পোশাকশিল্পের ৬০ শতাংশ বিনিয়োগই চীনাদের। আমরা মূলত এই জায়গাতেই পিছিয়ে পড়েছি।’

রপ্তানিতে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় অবস্থানে টিকিয়ে রাখতে সস্তার পাশাপাশি বেশি মূল্যেও পোশাক উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগ বিশেষ করে চীনা বিনিয়োগ আনতে হবে হবে মনে করেন কে এম রেজাউল হাসনাত। তিনি বলেন, ‘চীনাদের সঙ্গে বাংলাদেশে সংস্কৃতির তেমন একটা মিল নেই। তার বাইরে নানা রকম প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। সে কারণে চীনারা বিনিয়োগ করতে ততটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। তাই সরকারকেই বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে উদ্যোগ নিতে হবে।’

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু সুপারিশ
১. দেশে কতগুলো রপ্তানিমুখী কারখানা রয়েছে এবং সেখানে কত শ্রমিক কাজ করেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ফলে সরকারি পর্যায়ে নীতি নির্ধারণে নানা রকম জটিলতা হয়। অন্যদিকে মালিকপক্ষ সুবিধা গ্রহণের সময় কারখানা ও শ্রমিক সংখ্যা বাড়িয়ে বলেন। বিপদে পড়লে উভয় সংখ্যাই কমিয়ে দেখান। তাই সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান প্রস্তুতের উদ্যোগ দরকার। বিজিএমইএর একটি তথ্যভান্ডার করলেও সেটি পূণাঙ্গ হয়নি। অন্যদিকে বিকেএমইএ এ বিষয়ে উদাসীন। ফলে সরকারিভাবে কাজটি করা যায়।

২. পোশাকশিল্পকে সরকার নগদ সহায়তাসহ নানা রকম আর্থিক সুবিধা ও ছাড় দিচ্ছে বছরের পর বছর। তারপরও খাতটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে না। তাই আর্থিক সুবিধা ও ছাড় দেওয়া বন্ধ করে কারখানার প্রযুক্তিগত উন্নয়নে সরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে পারে। এতে করে কারখানাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত হবে। অন্যদিকে জনগণের করের টাকায় অন্য সম্ভাবনাময় খাতের পেছনে অর্থলগ্নি করতে পারবে।

৩. দীর্ঘদিন ধরে পণ্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও বাজার বহুমুখীকরণের কথা বলা হলেও আদ্যতে কোনো কাজ হয়নি। সরকারের তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে এ বিষয়ে অগ্রগতি ঘটাতে পারে। কারণ একমাত্র পোশাকের ওপর পণ্য রপ্তানি নির্ভরশীল হয়ে পড়াটি অর্থনীতির জন্য হুমকীস্বরূপ।

৪. ভবিষ্যতে ক্রেতারা লিড টাইম কম দেবেন। সেজন্য সমুদ্র বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। যাতে করে কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিতে অযথা সময় নষ্ট না হয়।

৫. পোশাকশিল্পের পশ্চাৎমুখী সংযোগশিল্প বিশেষ করে বস্ত্র খাতে নতুন বিনিয়োগ আনার জন্য সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ দরকার। এক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করা যেতে পারে।

৬. চার দশক বয়স হলেও বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা সস্তা পোশাক তৈরিতে বেশি নজর দিচ্ছেন। বেশি মূল্যের পণ্য তৈরিতে উৎসাহ ও সহযোগীতা দিতে কার্যকর উদ্যোগ দরকার। এ ক্ষেত্রে ইনোভেশন সেন্টার করা গেলে কাজে দেবে। কারণ অধিকাংশ উদ্যোক্তার পক্ষেই নতুন নতুন পণ্য উৎপাদনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য বিনিয়োগ করার সামর্থ্য নেই।

৭. দেশের উদ্যোক্তারা পোশাকের দর নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়েছেন। ফলে ক্রেতারা পোশাকের দাম কম দিতে সক্ষম হচ্ছেন। নিজেদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগীতা বন্ধে মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে উদ্যোগ নিতে হবে।

৮. এলসিডি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসলে বাংলাদেশ ইইউতে জিএসপি সুবিধা পাবে না। তখন শুল্ক মুক্ত সুবিধা বজায় রাখতে চাইলে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিতে হবে। সেজন্য যেসব কাজ করতে হবে তা এখনই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে সম্পন্ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে বেশি জোর লাগবে।

৯. যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে। বড় এই বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে সরকারি পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। না হলে গুরুত্বপূর্ন বাজারটিতে রপ্তানি কমে যেতে পারে।

১০. কারখানার সংস্কারকাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। অন্যদিকে তদারকি ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় নতুন করে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে পোশাকশিল্প আরেক সংকটে পড়বে। তাই পোশাক কারখানার সংস্কারকাজ সম্পন্ন করার পাশাপাশি তদারকি কাজ পুরোদমে গুরুত্ব সহকারে চালিয়ে নিতে হবে।

১১. শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় জোর দিতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন, হয়রানি বন্ধ, ছাঁটাইয়ে শ্রম আইনের লঙ্ঘন বন্ধ করতে হবে। না হলে বর্হিবিশে^ বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের সুনাম কখনই বাড়বে না। তাতে পরোক্ষভাবে হলেও রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

১২. শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে উদ্যোগ লাগবে। কারণ শ্রমিকেরা ভালো না থাকলে কোনভাবেই উৎপাদনশীলতা বাড়বে না। সেটি না বাড়লে ভবিষ্যতে টিকে থাকা মুশকিল হবে।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *