করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে কাজ হারানো মানুষের মিছিল বড় হচ্ছে। অপ্রাতিষ্ঠানিকখাতে কাজ হারানোর মানুষের সংখ্যা বাড়লেও প্রাতিষ্ঠানিকখাতে এখনো ঐ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে করোনা দুর্যোগ দীর্ঘায়িত হলে খরচ কমাতে মালিকরা বাধ্য হবেন কর্মী ছাঁটাইয়ে, ফলাফল হিসেবে এখাতেও কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়বে। তাই আসছে বাজেটে সরকারকে কর্মসংস্থানের দিকে বিশেষ নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট শিল্পপতি ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) এর সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান।
তিনি বলেন, করোনা থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে আসছে বাজেটে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান কর্মসংস্থান ধরে রাখা, তথা কারখানা মালিক যেন তার কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য না হন। সেজন্য কর ছাড়ের সুবিধা রাখা যেতে পারে। পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগের জন্যও থাকতে পারে কর প্রণোদনা। এর বাইরে করোনাকে কেন্দ্র করে যে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হচ্ছে সেগুলোর জন্য দ্রুত নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শও দিয়েছেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
আবুল কাশেম খান বলেন, সবচেয়ে বড় সংকট ও চ্যালেঞ্জ হলো কর্মসংস্থান ধরে রাখা, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা এবং বিনিয়োগ পরিস্থিতি। এক্ষেত্রে বাজেটকে সামনে রেখে ঢাকা চেম্বারের প্রস্তাব হলো ব্যবসায়ীরা যাতে অর্থ সংকটে না পড়েন সেজন্য বিভিন্ন স্তরে ৫ শতাংশ হারে কর ছাড় দিতে হবে। এটা বিশেষ সুবিধা দিবে বলে তিনি আশা করেন। অন্যদিকে যেসব মালিক কর্মী ছাঁটাই করবে না তথা কর্মসংস্থান ধরে রাখবে তাদেরকে আরো ২ শতাংশ অতিরিক্ত করছাড় দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি ছাড়কৃত করের অর্থ যদি কেউ পুন:বিনিয়োগ করে সেক্ষেত্রে আরো কিছু সুবিধা রাখারও প্রস্তাব করেছেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
তিনি বলেন, এই ধরনের সুযোগ সুবিধা দিতে পারলে এক দিকে কর্মী ছাঁটাই এর পরিমাণ যেমন কমবে, তেমনি নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হবে। আবুল কাশেম বলেন, করোনার কারণে এক দিকে যেমন অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে নতুন নতুন ব্যবসার সুযোগও তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিকম, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্সে নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এসব ব্যবসার সুযোগ যাতে উদ্যোক্তারা কাজে লাগাতে পারেন এবং এসব খাতে বিদেশি বিনিয়োগ যাতে আনা যায় সেজন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও দিক নির্দেশনা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনার ফলে বিনিয়োগ নীতিতে পরিবর্তন আনছে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন দেশের অন্যতম শিল্পগ্রুপ একে খান গ্রুপের এই কর্ণধার। আবুল কাশেম উদাহরণ হিসেবে বলেন, বিশে^র অনেক দেশই এখন চীন থেকে অন্য কোন দেশে তাদের বিনিয়োগ সরিয়ে নিয়ে চাচ্ছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এসব বিনিয়োগ ধরার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে একটি বিশেষ টিম তৈরি করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশেরও উচিত এসব সুযোগ ধরতে এখনই চেষ্টা করা।
এক্ষেত্রে অবশ্য সরকারি নীতি গ্রহণের দীর্ঘসূত্রিতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে আবুল কাশেম বলেন, এসব বিনিয়োগ গ্রহণের সুযোগ বেশি দিন থাকবে না। তাই সরকারের উচিত হবে এস বিষয়ে যতদ্রুত সম্ভব নীতিগত সিদ্ধান্ত ও কৌশল গ্রহণ করা। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ খাতে অন্তত জিডিপি’র ৩ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে পারলে ভালো হবে। সরকারের অর্থ সাশ্রয়ে কৌশলী হতে হবে উল্লেখ করে তার পরামর্শ, যে সব প্রকল্প খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় সেগুলোতে আগামী দুই তিন বছর কোন বরাদ্দ না রাখাই ভালো। ঐ অর্থ করোনা মোকাবেলার জন্য প্রকল্পে সরিয়ে নোর পরামর্শ দিয়েছেন আবুল কাশেম খান।
প্রধানমন্ত্রীর স্টিমুলাস প্যাকেজ ঘোষণায় ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবাখাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণসুবিধাসহ আরও সুবিধা ঘোষণা দিয়েছে সরকার। একে সাধুবাদ জানিয়ে আবুল কাশেম খান বলেন,এটা খুব সাহসী পদক্ষেপ হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীদের মনের জোর বাড়বে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেও্য়ার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত দেয়া হয়েছে। যেমন বলা হচ্ছে ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ৩০ শতাংশ দেয়া হবে। সেটা আবার ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে দেয়া উচিত। এমন কিছু শর্ত পুনবিন্যাসের আহ্বান জানান তিনি।
আবুল কাশেম বলেন, যে ব্যবসায়ীদের ব্যাংকে একাউন্ট নেই তারাও যেন সহজে ঋণসুবিধা নিতে পারে সেটিও দেখতে হবে। ছোট ও মাঝারি ধরনের ব্যবসায়ীদের অনেকের সঙ্গে ওনাদের (ব্যাংকের) লেনদেন নাই বলতে পারেন। যারা ধার করে বা বিভিন্নভাবে সঞ্চয় করে টাকাটা ব্যবসায় লাগিয়েছেন। এমন ব্যবসায়ীরা এখানে বাদ পড়ে যাবেন। আমরা তাদের কথাটাও বিবেচনায় রাখতে বলেছি।
সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা বাস্তবায়ন, মনিটরিং, করোনার প্রভাব মূল্যায়ন ইত্যাদি সমন্বয়ের জন্য ন্যাশনাল ইকোনমিক ট্রাসফোর্স গঠন করলে তা সুদূরপ্রসারী কাজ হবে বলে মনে করেন সাবেক ডিসিসিআই সভাপতি। তিনি বলেন, এখানে ব্যবসায়ী নেতারা, বিভিন্ন এসোসিয়েশন নেতারা থাকবেন; অর্থ মন্ত্রণালয়, এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা থাকবেন, অর্থনীতিবিদরা থাকবেন। তারা আমাদের অর্থনীতির উপরে করোনার প্রভাব নিয়ে কাজ করবেন। কোন কোন খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা মূল্যায়ন করবেন। সমন্বয় করবেন। মানিটরিং বলেন, এক্সিকিউশন বলেন সেটা করবে। এটা করা হলে প্রণোদনাটা একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
ন্যাশনাল ইকোনোমিক ট্রাস্কফোর্সের খাতভিত্তিক কমিটি হতে পারে। আবুল কাশেম খান বলেন, তাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। ধরেন,একটি কমিটি অর্থনীতি নিয়ে কাজ করলো,একটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নিয়ে কাজ করলো, একটা গ্রুপ রপ্তানি নিয়ে কাজ করলো,বন্দর নিয়ে কাজ করলো।তাহলে আমার মনে হয় মনিটরিংটা ভালো হবে।
করোনার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এমন মন্তব্য করে আবুল কাশেম খান বলেন,অবশ্যই বড় ফ্যাক্টরিও এফেক্টেট হবে। কিন্তু এখানে প্রধান এফেক্টেট হবে ছোট প্রতিষ্ঠান। বড় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা আছে এটা কাটিয়ে ওঠার।কিন্তু ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার মতো সক্ষমতা নেই। তারা ব্যাংকিং সাইটের বাইরে কাজ করছে।
কৃষি ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে জোর দেয়ার তাগিদ দিয়ে আবুল কাশেম খান বলেন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। করোনার কারণে এখন বিশ^ায়নের অর্থনীতি থেকে স্বদেশী অর্থনীতি হতে হবে। বলতে পারে, এটা নতুন ট্রেন্ড। আপনি যতটুকু সেলফ সাফিসিয়ান করতে পারবেন তত নিরাপদ থাকবেন আপনি। আপনি কৃষি দিয়ে, নিজস্ব উৎপাদন দিয়ে সেইফ থাকবেন। অনেক দেশ তাদের খাদ্যপণ্য আগে মজুদ করবে, তারপর রপ্তানির কথা ভাববে মন্তব্য করে আবুল কাশেম খান বলেন, এখন আমাদের নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। আমাদের অর্থনীতিকে, কৃষিকে আধুনিকায়ন বলি বা কমার্সিয়ালাইজ বলি, এটা গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।