করোনার ধাক্কায় বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের অনেকে কাজ হারিয়েছেন, অনেকে দেশেও চলে আসছেন। যারা বিদেশে অবস্থান করছেন তাদের অনেককে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। তাদের পাশে দাঁড়াতে আসছে বাজেটে, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়ানো ও সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন অভিবাসী বিশেষজ্ঞ ও অভিবাসন গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর (রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপার্সন ড. তাসনিম সিদ্দিকী। ইআরএফ মিডিয়াকে দেয়া এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারকে কয়েকটি জায়গায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যারা ফেরত আসছে তাদের সঠিক তালিকা করা, তাদের মধ্যে দক্ষদের দেশেই বিভিন্ন খাতে কাজে লাগানো, অদক্ষদের পুন:দক্ষ করতে কর্মসূচি হাতে নেয়া, শ্রমিক ফেরত ঠেকাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জোরালো ভূমিকা রাখা ও নাইন্টিন নাইনন্টি কনভেশনকে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতের জন্য সামনে নিয়ে আসা।
সব সময়ই ঝুঁকিতে অভিবাসীরা
ড. তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, অভিবাসীরা যে সব সময়ই ঝুঁকির মধ্যে থাকে, সে কথা ১৯৩০ সালেই বলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। অতীতের চিত্র খুব একটা বদায়লনি বরং পুরো বিশ^ জুড়েই এখনো দুর্বল শ্রম শক্তি হচ্ছেন, অভিবাসীরা। যে কোন দুর্যোগে তাদের ওপরই সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে। ১৯৭৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১ কোটির বেশি মানুষ অভিবাসী হয়েছে। তবে কত মানুষ ফেরত এসেছে তার কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও এই অভিবাসী বিশেষজ্ঞ জানান, এই মুহূর্তে বিশে^র বিভিন্ন দেশে ৫০ লাখের মত বাংলাদেশির কর্মসংস্থান আছে।
কষ্টে আছে বাংলাদেশিরা
করোনার ফলে তাদের মধ্যে এক লাখ মানুষ অর্ধহারে অনাহারে জীবন কাটাচ্ছে। তাদের ওপরই সংক্রমেণর হার সবচেয়ে বেশি। তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, সিঙ্গাপুরে চার হাজার অভিবাসী সংক্রমিত হয়েছে, যাদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যাই বেশি। এখন পর্যন্ত করোনায় ৬০০ এর বেশি বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে প্রাণ হারিয়েছেন। ৫০ হাজারের বাংলাদেশি বাড়ি ভাড়া দিতে পারছে না। তাদের জন্য সরকার ১০ কোটি টাকার সহায়তা তহবিল ঘোষণা করেছে। এটি ভালো উদ্যোগ হলেও সহায়তার পরিমাণ আরো বাড়ানো ও এককালীন সহায়তার দাবী জানিয়েছেন অনেক অভিবাসী।
স্ববিরোধী অবস্থানে কর্মী নিয়োগকারী দেশগুলো অভিবাসীরা যখন এই ধরনের পরিস্থিতিতে, তখন আরেক বড় বিপদ হলো বিভিন্ন রাষ্ট্র করোনা বিপর্যয়ের মাঝেই তাদের স্বস্ব দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। করোনা মোকাবেলায় যখন বলা হচ্ছে সবাই ঘরে থাকুন কিন্তু অভিবাসী শ্রমিকদের বেলায় তা মানা হচ্ছে না। বরং এই দুর্যোগের মধ্যেও তাদের পাঠিয়ে দিয়ে ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের পরিচয় দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। ড. তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, শুধু সৌদি আরব নয় কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এমনকি মালদ্বীপ থেকেও বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। দেশগুলো বলছে, অনিয়মিত অভিবাসীদের পাঠিয়ে দিচ্ছে তারা। অথচ, আমরা জানি তারা কিভাবে অনিয়মিত হন। ভিসার মেয়াদ শেষ হলে দেশগুলোর নানা ধরনের মেকানিজমের (কুটকৌশল) কারণে এই অনিয়মিত হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে।
আন্তর্জাতিক আইন মানা হচ্ছে না
তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, এই অনিয়মিত শ্রমিক দিয়েই সাধারণ সময়ে তারা তাদের কাজ করিয়ে থাকেন। এখন দুর্যোগ এর সময় তারা ঘাড় থেকে দায়িত্ব সরিয়ে ফেলে শ্রমিকদের বিতাড়িত করতে চাইছে। এটা অত্যন্ত দু:খের। এর জন্য বাংলাদেশকে ফাইট করতে হবে উল্লেখ করে তাসনীম সিদ্দিকী এক্ষেত্রে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক কিছু রীতি নীতি মানার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো ঠেকাতে সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা কে দিতে পারে? নাইন্টিন নাইন্টি (১৯৯০) যে কনভেশন রয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী ও তাদের পরিবারের জন্য সেখানে স্পষ্ট বলা আছে-কোন অবস্থায়ই কালেকটিভ এক্সপানশন করা যাবে না; বরং এই ধরনের পরিস্থিতিতে মাইগ্রেন্ট ইন ক্রান্টিজ অব ক্রাইসিস ডকুমেন্ট, যেটা তৈরি হয়েছে নিউইয়র্ক ডিক্লারেশনের পর, সেখানে বলা হয়েছে দুর্যোগে তাদেরর রক্ষা করবে গ্রহণকারী দেশ। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না, ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে আমাদের সরকারকেও বাধ্য হয়েই অনেক সময় রাজি হতে হচ্ছে।
জোরালো আওয়াজ তুলতে হবে
করোনার বিপর্যয়ে শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো ঠেকাতে কী করতে পারে বাংলাদেশ? এক্ষেত্রে তাসনীম সিদ্দিকীর পরামর্শ হলো, বিষয়টি বহুপাক্ষিক ফোরামে বাংলাদেশকে উত্থাপন করতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে মুসলিম দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সংস্থা-ওআইসিতে বলেছে যে, আমার শ্রমিকদের ফেরত পাঠাতে হলে নিয়োগকারী দেশকে ৬ মাসের বেতন দিয়ে ফেরত পাঠাতে হবে। এই কথটাই সরকারকে অন্যান্য বহুপাক্ষিক ফোরামে জোরের সাথে বলার পরামর্শ দিয়েছেন ড. সিদ্দিকী। যেমন: কমপ্যাক্ট, জাতিসংঘের মহাসচিব, আবুধাবি ডায়ালাগ, কলম্বো প্রসেসকে আবারো চাঙ্গা করে বাংলাদেশ তার এই দাবী জোরেশোরে করতে পারে।
ঋণ তহবিলের সুদহার কমানো উচিত
যেসব অভিবাসী ফেরত আসছে তাদের জন্য রামরু ও ১৬টি সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা এক খোলা চিঠিতে জরুরী তহবিলের ব্যবস্থা করার দাবী জানানো হয়েছিল। তাসনীম সিদ্দিকী জানান, প্রধানমন্ত্রী আমাদের আহবানে সাড়া দিয়ে ৫০০ কোটি টাকা তহবিল করে দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় নিজস্ব ভাবে আরো ২০০ কোটি টাকা দিয়ে মোট ৭০০ কোটি টাকার ঋণ প্রকল্প নিয়েছে। এখান থেকে ৪ শতাংশে সুদে অভিবাসীদের ঋণ দেয়া হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি হিসেবে তৈরি পোশাকখাতের মত সুদের হার আরো কমিয়ে ২ শতাংশ করার সুপারিশ করেছেন তাসনিম সিদ্দিকী। তৈরি পোশাকখাতের তুলনায় এই ঋণ তহবিল তহবিল মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, তহবিলের পরিমাণ আরো বাড়ানো উচিত।
অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা বন্ধ করতে হবে
বাংলাদেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পিছনে শুরুতে অভিবাসীদের দায়ী করা হয়েছিল। এটি এক ধরনের প্রপাগান্ডা উল্লেখ করে তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ঐ সময়ে অনেকে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসলেও শুধুমাত্র দায়ী করা হয়েছে বিদেশ ফেরত অভিবাসীদের। এই নেতিবাচক পরিস্থিতি দূর করতে হবে। তাদের দায়ী করার ব্যাপারটা বন্ধ করতে হবে। এখনো অনেক অভিবাসী আসছেন, সামনে আরো আসবেন উল্লেখ করে এই অভিবাসন বিশেষজ্ঞ জানান, সম্প্রতি ওমান, কাতার থেকে যারা ফেরত এসেছেন তাদের কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়নি। ঐসব দেশ থেকে দেয়া স্বাস্থ্য সনদই মেনে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাদের মধ্যে কেউ যদি আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে তার জন্য দায়ী কে হবে? এমন প্রশ্ন রেখে তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, রামরুর পক্ষ থেকে দাবী হচ্ছে আগামীতে যারাই ফেরত আসবেন তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে পাঠাতে হবে।
সংকটেও সুযোগ আসবে
করোনা দুর্যোগ চলে যাওয়ার পর খরচ কমিয়ে আনতে বহু দেশ অভিবাসী শ্রমিকদের ছাঁটাই করবে। তবে একই সাথে নতুন কর্মী পাঠানোর খাতও তৈরি হবে বলে ধারণা করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ তাসনিম সিদ্দিকী। তার মতে, এটা ঠিক যে গতানুগতিক খাতে লোক হয়তো আর নিবে না। তবে অন্যান্য খাত যেমন- ক্লিনিং সেক্টর। করোনা চলে গেলে হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ এসব যখন খুলবে সেখানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা একটা বড় ব্যাপার হবে। তখন এসব কাজে নতুন করে লোকবল লাগবে। অন্যদিকে কর্মী নিয়োগকারী দেশগুলো স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বাড়াবে তাতে সন্দেহ নেই। তখন নতুন লোকবলের চাহিদা তৈরি হবে। আমরা যদি স্বাস্থ্যখাতে দক্ষ টেকনিশিয়ান, নার্সসহ অন্যান্য লোকবল তৈরি করতে পারি তাহলে তাদের ঐ সব দেশে পাঠানো যাবে। ফলে যে ভয়টা পাচ্ছি যে আমরা জনশক্তি রপ্তানির বাজার হারাবো, সেটা হারাবো ঠিকই; তবে সময়মতো সঠিক উদ্যোগ নিতে পারলে এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবো।
তাহলে করণী কী?
ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, এ জন্য প্রয়োজন পড়বে প্রাতিষ্ঠানিক কৌশলপত্র তৈরি করা। শুধু আগামী ৫ বছরের জন্য নয় বরং স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আগামী দুই বছরের বাজেটে এর প্রতিফলন থাকতে হবে। সবচেয়ে কম বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয়গুলোর একটি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। বাজেটে এই মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। দূতাবাস গুলোতে শ্রম উইং এর লোকবল বাড়াতে হবে। সরকারের প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে এনে সেই অর্থ অভিবাসীদের জন্য ব্যয় করা যেতে পারে। তিনি বলেন, আমরা জানি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রেমিটেন্স। ইতিমধ্যে করোনার ধাক্কায় এই আয় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। এটা মাথায় রেখেই আসছে বাজেটে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ও গুরুত্ব অনেক বাড়াতে হবে। দেশে যদি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করা না যায় তাহলে লোকজন মরিয়া হয়ে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করবেই। সেই মরণ যাত্রা ঠেকাতে আমাদের দক্ষ কর্মী গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই।
ফেরত আসা অভিবাসীদের জন্য করণীয়
ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, প্রথমত যারা ফেরত আসছে তাদের একটি তালিকা করতে হবে। এর মধ্যে যারা দক্ষ শ্রমিক তাদের জন্য আলাদা একটি তালিকা করতে হবে। বাংলাদেশে ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের শ্রমিকরা অনেকখাতে কাজ করে। করোনার ফলে তারা এখন নিজ দেশে ফেরত গেছে। যদি ঐ সব খাতে আমাদের ফেরত আসা দক্ষ শ্রমিকদের কাজে লাগানো যায় তাহলে যে রেমিটেন্স বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর চলে যাচ্ছে তা কিছুটা কমিয়ে আনা যাবে। সেই সাথে ফিরে আসা শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য ঋণ প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। তারা যখন আবার ফেরত যাবে তাদের পূর্ণ সহায়তা দিতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর কর্মসূচি গুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এসমস্ত কাজ করতে পারলে যতটা ক্ষতি আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন রামরুর চেয়ারপার্সন ড. তাসনিম সিদ্দিকী।