বিদায়ী বছরে নিত্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল পেঁয়াজ। মসলাজাতীয় এ পণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়ে এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির পদত্যাগের দাবিও উঠেছিল। যদিও একপর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে পেঁয়াজের দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে নতুন বছরে যেন এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সে লক্ষ্যে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি জোর দেয়া হচ্ছে।
দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বর থেকে। ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত রফতানি মূল্য দ্বিগুণ করে প্রতি টন ৮৫০ ডলার করার পর হুট করে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায় ঢাকার বাজারে। ২৯ সেপ্টেম্বর পাশের দেশটি রফতানিই বন্ধ করে দিলে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। স্বাভাবিক বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০ টাকা থাকলেও মাস শেষে শ’ ছাড়িয়ে যায়। অক্টোবরে পেঁয়াজ বিক্রি হতে থাকে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকার মধ্যে। ওই মাসের শেষভাগে সরকার আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে আমদানি বাড়িয়ে পেঁয়াজের দাম ফের ১০০ টাকার কাছাকাছি নিয়ে এলেও ৯ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। ক’দিনের মধ্যেই ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায় প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম। সব রেকর্ড ভেঙে এক পর্যায়ে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয় পেঁয়াজ।
দেশে পেঁয়াজের বাজারে এ অস্থিরতার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরেও প্রকাশ পায়। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে আমাদের সামান্য সমস্যা হলো। আমি জানি না, কেন আপনারা পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছেন। আগে থেকে (রফতানি বন্ধের কথা) জানালে আমরা অন্য জায়গা থেকে (পেঁয়াজ আমদানির) ব্যবস্থা করতাম।
বাজারদরে এই অস্থিরতার মধ্যে সরকারের মন্ত্রীরা রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার কমানোর পরামর্শ দিলে তা বিরোধী রাজনীতিকদের আক্রমণের হাতিয়ারও হয়ে ওঠে। পেঁয়াজের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকায় সংসদের ভেতরে নিজ দলের সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও। এমনকি তার পদত্যাগের দাবি ওঠায় একদিন বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, পদত্যাগ করলে যদি পেঁয়াজের দাম কমে যায়, তাহলে পদত্যাগ করাটা এক মিনিটের ব্যাপার।
জনসাধারণের ভোগান্তি বিবেচনায় নিয়ে পেঁয়াজ সংকট কাটাতে উদ্যোগী হয় সরকার। কোনো দিন পেঁয়াজের ব্যবসা না করা বড় বড় কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানিও উদ্যোগী হয়ে চীন, মিসর, তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করে। তার ফল কিছুটা হলেও এখন মিলছে বাজারে। ১০০ টাকার আশপাশে মিলছে প্রতি কেজি পেঁয়াজ।
এ সংকটের অভিজ্ঞতা থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। উৎপাদন বাড়িয়ে সঠিক তদারকির মাধ্যমে বাজারজাত করলে পেঁয়াজ নিয়ে নজিরবিহীন সংকটে পড়তে হবে না জনসাধারণকে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করতে হবে। আগামী বছর থেকে ৩০-৩২ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদনের পরিকল্পনা করতে হবে। এজন্য পেঁয়াজের ক্ষেত্রে শূন্য সুদে ঋণ দেওয়া যায় কি-না চিন্তা করছি। এখন ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয়। যেভাবেই হোক কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। সংরক্ষণ সক্ষমতা বাড়াতে হিমাগার তৈরির ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়া হবে। পাশাপাশি ভর মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখে কৃষকদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বর্তমানে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। ১৬ থেকে ১৭ লাখ মেট্রিক টন দেশে উৎপাদিত হয়। বাকি ৮ থেকে ৯ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করা হয়। পেঁয়াজ আমদানির ৯৫ শতাংশের বেশি আসে ভারত থেকে।
পেঁয়াজে কীভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা যায় তার একটা রূপরেখা দিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ। পেঁয়াজ নিয়ে অস্থিরতার মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক সভার পর সাবেক এ বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভারত গরু বন্ধ করে দিলো। আমাদের দেশের মানুষ গরু পালতে শুরু করল, আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন পেঁয়াজের দাম বাড়ল। আমরা মনে করি, আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ বাড়ির খোলা জায়গায় পেঁয়াজ চাষ করবে। আগামী দুই বছরের মধ্যে ইনশাল্লাহ পেঁয়াজ রফতানিকারক দেশে পরিণত হব।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ও মনে করছে, কৃষকেরা পেঁয়াজের দাম পেলে ৮-৯ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ বাড়তি উৎপাদন করা সম্ভব। মূলত পেঁয়াজ হার্ভেস্টিংকালে (পেঁয়াজ উত্তোলনকালে) কৃষকেরা দাম পান না। এজন্য পেঁয়াজ উৎপাদনে আগ্রহী হন না তারা। তাই পেঁয়াজ উত্তোলন মৌসুমের চার মাস- বিশেষ করে এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাইতে সব ধরনের পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রাখা গেলে সুফল মিলবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষকরা পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য পেলে চাষে উৎসাহী হন। চার মাস পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকলে কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং দেশে পেঁয়াজের সংকট থাকবে না।
জানা গেছে, পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের প্রস্তাবের ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইতোমধ্যে কয়েক দফা বৈঠকও হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওই প্রস্তাব ইতিবাচকভাবে দেখেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। চার মাস পেঁয়াজ বন্ধের বিষয়ে সবাই একমত পোষণ করেছেন। নতুন বছরেই এ বিষয়ে আইন পাস হবে এবং এপ্রিল থেকে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে।
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ অনুবিভাগ) সনৎ কুমার সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বছর পেঁয়াজ অনেক অস্থিরতা তৈরি করেছে বাজারে। পেঁয়াজ নিয়ে নতুন করে সংকট চাই না। আমরা পেঁয়াজের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করবো। বর্তমানে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। আমার বিশ্বাস, কৃষক দাম পেলে ৩০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন সম্ভব। তাই হার্ভেস্টিং সময়ে আর পেঁয়াজ আমদানি নয়। বাণিজ্যমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বলেছি, তিনিও নীতিগত সমর্থন দিয়েছেন।’