শ্রম অধিকারের বিষয়ে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। ফলে শ্রম ইস্যুতে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো কোনো অবস্থা বা পরিবেশ নেই। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম নীতির আওতায় বাণিজ্যের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা এলে সেটি হবে রাজনৈতিক।
বর্তমান শ্রম ইস্যু ও বিশ্ব বাণিজ্য চিত্র নিয়ে অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সেমিনারে তৈরি পোশাকশিল্পের নেতারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে আজ সোমবার আয়োজিত এই সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
অনুষ্ঠানে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন দেশ এবং চীনের মতো উন্নত দেশের চেয়েও আমাদের শ্রমমান এগিয়ে। তারপরও নিষেধাজ্ঞা দিলে তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য করা হবে। তিনি আরও বলেন, নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ভীতি নেই। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিষেধাজ্ঞা দিলে কিছু বলার থাকবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতি ঘোষণার পর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, সেদিকে ইঙ্গিত করে বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সেটি রাজনৈতিক। আমরা আমাদের কথা বলব। তবে বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।’
শ্রম অধিকার বিষয়ে অনেকটা মালিকদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে শ্রমিক সংগঠনের জোট ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সভাপতি আমিরুল হক বলেন, ইদানীং নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। তবে পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, নিষেধাজ্ঞায় পড়ার মতো খারাপ অবস্থা দেশে নেই। শ্রমমানের অনেক উন্নতি হয়েছে। শ্রম অধিকার বিষয়ে মৌলিক ১০টি কনভেনশনের মধ্যে ৮টি অনুসমর্থন করেছে বাংলাদেশ। আর যুক্তরাষ্ট্র অনুমোদন করেছে মাত্র দুটি কনভেনশন। ফলে বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের নেই।
যুক্তরাষ্ট্র গত ১৬ নভেম্বর বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার সুরক্ষায় নতুন নীতি ঘোষণা করে। আনুষ্ঠানিকভাবে এ নীতির বিষয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, যাঁরা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবেন, শ্রমিকদের হুমকি দেবেন, ভয় দেখাবেন, তাঁদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
মার্কিন এই নীতির বিষয়ে ২০ নভেম্বর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে ‘শঙ্কা’ প্রকাশ করে বাণিজ্যসচিবকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, শ্রম অধিকারবিষয়ক নতুন এ নীতির লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বাংলাদেশ। কারণ, শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে নীতিটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের ওপর আরোপের সুযোগ রয়েছে।
সেমিনারে আইবিসির সভাপতি আমিরুল হক আরও বলেন, পোশাকশ্রমিকদের মজুরি এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে। শ্রম সংগঠন করতে এখনো সমস্যায় পড়তে হয়। তা ছাড়া ক্ষতিপূরণ আইন আধুনিক করা হয়নি। শ্রম আইন সংশোধন যে প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে, সেটি গ্রহণযোগ্য হয়নি। এটি আন্তর্জাতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য হবে না। শ্রম আইন সংশোধনের সুপারিশ করার সর্বোচ্চ ফোরাম হচ্ছে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ (টিসিসি)। সেই পরিষদে শ্রম আইন সংশোধন সম্পর্কিত ৫৩টি বিষয় অমীমাংসিত ছিল। ১২ জন নিয়ে গঠিত একটি সাব কমিটিতে সেগুলো সমাধান হওয়ার কথা ছিল। তার আগেই শ্রম মন্ত্রণালয় শ্রম আইন সংশোধনের বিল সংসদে উত্থাপন করে।
আইবিসির কেন্দ্রীয় নেতা তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘তৈরি পোশাক আন্তর্জাতিক ব্যবসা। তাই ব্যবসা ধরে রাখতে বৈশ্বিক শ্রম মান নিশ্চিত করতে হবে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, পশ্চিম আকাশে মেঘের ঘনঘটা রয়েছে।’
তৌহিদুর রহমান আরও বলেন, মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে চারজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। মালিকপক্ষ নিহত শ্রমিক পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। তবে শ্রমিক নিহতের ঘটনার তদন্ত হওয়া দরকার। আমরা ১২ হাজার ৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি মেনে নিলাম। আমাদের বিজয় হয়নি। আমরা সহযোগিতা করলাম। তারপরও ১১৫ জন আঞ্চলিক শ্রমিক ও শ্রমিকনেতা কারাগারে। ৪৩ মামলা ২০ হাজার শ্রমিক আসামি। এ বিষয়গুলো বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে বিবেচনা করতে হবে।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান এবং বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক এ এন এম সাইফুদ্দিন।
যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলে সেটি হবে রাজনৈতিক, বলছেন ব্যবসায়ীরা