বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি বিচক্ষণতা প্রয়োজন। আমাদের দেশে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় একধরনের আউট অব বক্স (বৃত্তের বাইরে) চিন্তা করা হয়। বলা হয়, আমরা ব্যতিক্রম। কিছু ভিন্নতা থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির বেসিক একই। আর আমরা তো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নই। ফলে আমাদের বুঝতে হবে, কখন কোথায় কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা আমরা খুব একটা গুরুত্বসহকারে নিই না। প্রথাগত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা প্রকাশে দক্ষ।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা আমরা খুব একটা গুরুত্বসহকারে নিই না। প্রথাগত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা প্রকাশে দক্ষ। তাঁরা দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে বিরুদ্ধ মন্তব্য করেছিলেন। করোনায় পাঁচ লাখ মানুষ মারা যাবে বলেও শঙ্কা ছিল তাঁদের। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। অবশ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ হবে কি না, জানি না।’ তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ পরিকল্পিতভাবেই এগোচ্ছে। পরিকল্পনায় কোনো দুর্বলতা নেই। তবে দারিদ্র্য বিমোচনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে একটু সময় বেশি লাগবে।
জ্বালানি-সংকট নিয়ে ভয়
জ্বালানি-সংকট নিয়ে ব্যবসায়ীরা ভয়ের মধ্যে আছেন বলে মন্তব্য করেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান। তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যবসার প্রতিযোগিতা সক্ষমতার মূল উপাদান জ্বালানি। বর্তমানে জ্বালানি–সংকটের মধ্যে আমরা কীভাবে এগিয়ে যাব, সেটাই এখন বড় বিষয়। তবে জ্বালানি–সংকট কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে ভয় কাজ করছে।’
ব্যবসাবান্ধব করনীতি প্রণয়ন ও করজাল বাড়ানোর আহ্বান জানান আবুল কাসেম খান। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক বেশি নিয়মকানুনের মধ্যে আছি। ১ জনকে ধরার জন্য বাকি ৯৯ জনকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে।’ নিজের কোম্পানির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, গত বছর ৬৬ শতাংশ কর দিয়েছেন। সেটি ৩০ শতাংশ হওয়া উচিত। এভাবে চলতে থাকলে প্রথম প্রজন্মের কোম্পানিও টিকে থাকতে পারবে না।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ঢাকার (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, ‘জ্বালানি খাতের আমদানিনির্ভরতা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে রেখে জ্বালানি সাশ্রয় করতে হচ্ছে। জ্বালানির দাম বাড়ানোর আগে আমরা পরিষ্কার কোনো বার্তা পাইনি। সবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলার পর আমরা পরিষ্কার ধারণা পেয়েছি। এর আগে বিভিন্ন ধরনের কথা শোনা যাচ্ছিল। তার মধ্যে একটি, ডিজেল ভারতে চলে যাচ্ছে। ডিজেল কি সাইকেল করে ভারতে পাড়ি দিচ্ছে? তাতে কতটা প্রভাব পড়ছে?’
নিহাদ কবির বলেন, ‘আমরা ১০-১৫ বছর ধরে গ্যাস অনুসন্ধান করি নাই কেন? কার স্বার্থে গ্যাস অনুসন্ধান বন্ধ ছিল? জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী, বাংলাদেশের মানুষকে তা জানানো দরকার। পরিকল্পনা ভালো হলে আমরাও সমর্থন দেব। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ।’
অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি বিচক্ষণতা প্রয়োজন। আমরা তো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নই। ফলে আমাদের বুঝতে হবে, কখন কোথায় কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতে ডিজেলের দাম আমাদের চেয়ে মাত্র দুই টাকা বেশি। তার মানে আমরা জ্বালানি তেলের দাম খুব বেশি বাড়িয়ে ফেলেছি, তা নয়। এটা মূল্যস্ফীতিকে ইন্ধন দিচ্ছে, মানুষের কষ্ট হচ্ছে, সত্য।’ বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমলে দেশেও দাম সমন্বয় করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
ডলার ভিন্ন ভিন্ন দর
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে ৯৫ টাকায়। আমদানি-রপ্তানিকারকদের জন্য ডলারের দর ভিন্ন। কোনো কোনো ব্যাংক প্রবাসী আয় আনছে প্রতি ডলার ১১৩ টাকায়। খোলাবাজারে ডলারের দাম ১২০ টাকাও উঠেছিল।
এমন তথ্য দিয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ব্যাংকগুলো একেক জনের কাছ থেকে একেক দামে ডলার কিনছে। বিক্রির ক্ষেত্রেও তা–ই। ব্যাংকগুলো ডলার বেচাকেনায় এক টাকা মুনাফা করতে পারলে কার ডলার কাকে দেবে, সেটি আরেক সমস্যা। তারপরও আমি আশাবাদী, ডলারে বিনিময় হারে একটা সংশোধন হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ডলারের দাম ১০৪-১০৭ টাকার মধ্যে স্থির হলে ভালো। তবে মুদ্রানীতি থেকে আগেই সহায়তা দিতে পারলে হয়তো ডলারের দাম আরও পাঁচ টাকার কমে স্থিতিশীল করা যেত। তবে নয়-ছয় সুদহারের জন্যই সেটি করা যায়নি।’
ডলারের বিভিন্ন দাম থাকবেই বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ডলারের বিনিময় হারে শৃঙ্খলা রাখতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। খোলাবাজারের দর নিয়ে চিন্তিত হলে হবে না। ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য যেন মসৃণভাবে চলে, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা দিয়ে যাবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে তর্ক
এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির সম্প্রতি নিজের গ্রামের বাড়ি ঘোড়াশালে গিয়েছিলেন। সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘চালের দাম, মাছের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ সত্যিই কষ্টে আছেন। সবার একই কথা, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে আর আমাদের দেশে কেন বাড়ছে। কবে দাম সমন্বয় করা হবে।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিগত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬-৭ শতাংশ। চলতি মাসে ঠিকভাবে গণনা করলে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে উঠে যাবে। এটি ভয়ের কিছু নয়। যুক্তরাজ্যেও মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ১ শতাংশ। সমস্যা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি যখন দ্রুত সমন্বয় করতে হয়, তখন মজুরির ওপর চাপ পড়ে। মজুরি বাড়ানোর জন্য চা-বাগানের শ্রমিকেরা আন্দোলন করছেন। কাল হয়তো পোশাকশ্রমিকেরা নামবেন। পরশু হয়তো সরকারি কর্মচারীরা। একসঙ্গে সবাই নামলে বিপদ। এটা হতে দেওয়া যাবে না। আগেই মজুরি সমন্বয় করতে হবে।
পিআরআইয়ের এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমাদের রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়বে। আমদানিও কমে আসবে। ডলারের বিনিময় হারও একটা পর্যায়ে আসছে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছুই করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে। প্রতিটি দেশই এমন ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু আমাদের হাতিয়ার নেই। মূল্যস্ফীতি বাড়লে কী করতে হবে, তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি থাকলেও সহায়ক নীতি নেই। তারা নয়-ছয়ে বাঁধা।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সরকার সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তবে চালের উৎপাদন কম হয়েছে। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমনের উৎপাদন ভালো হবে না। বোরোতেও ক্ষতি হয়েছে। ফলে চালের দাম বাড়বে। বাজারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ, চাহিদার তুলনায় চালের ঘাটতি আছে। অন্যদিকে আমদানিও পর্যাপ্ত হয়নি। ভালো খবর হচ্ছে, ভারতে উৎপাদন ভালো হয়েছে। তারা আমাদের দিতে পারবে।’
অন্যদিকে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি—এ কথা ভুল। আমরা বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করেছি। ডলারের বিনিময় হার বাগে আনলাম।’ তিনি বলেন, কৃষির উৎপাদনব্যবস্থা ভালো আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দামও কমছে। ইউক্রেন থেকে খাদ্য রপ্তানি শুরু হয়েছে। ফলে অক্টোবর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেশি থাকবে। এই দুই মাস পর মূল্যস্ফীতি স্বস্তির জায়গায় আসবে। সবশেষে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা উন্নত দেশ হয়ে যাইনি। কিছু তো সমস্যা থাকবেই।’
জ্বালানি–সংকট নিয়ে ভয়, মূল্যস্ফীতি নিয়ে শঙ্কা