বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানিখাত চামড়া। রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক হলেও এ খাত সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানিতেই এক তৃতীয়াংশ বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায়। অর্থাৎ মূল্য সংযোজনের সুযোগ কম। তবে চামড়া খাতে এই সুযোগ অনেক বেশি। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজত করতে রাসায়নিক ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে সামান্য এক্সেসরিজ ছাড়া তেমন কিছু আমদানির প্রয়োজন পড়ে না। অন্যান্যখাতের মত চামড়াশিল্পেও করোনার থাবা হানা দিয়েছে। একদিকে রপ্তানি চাহিদা যেমন কমছে, তেমনি আসন্ন কোরবানির ঈদে পশু কোরবানি থেকে শুরু করে চামড়া সংগ্রহ ও তা প্রক্রিয়াজাত করা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণে সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট পক্ষদের নিয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভায় সকলেই একমত হয়েছেন, করোনার অভিঘাত থেকে চামড়া শিল্পকে রক্ষায় আলাদা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা উচিত। পাশাপাশি আসছে ঈদুল আযহায় চামড়া কিনতে সহজ শর্তে ঋণও দিতে হবে। এছাড়া সুদ মওকুফ, আগের খেলাপি ঋণ ব্লক একাউন্টে জমা এবং চামড়াখাতের জন্য খেলাপির সংজ্ঞা পরিবর্তনের জোর দাবী জানানো হয়েছে। এসব উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব থেকে শুরু করে চামড়া ব্যবসায়ীরা।
চামড়াখাতে খেলাপি ঋণ:
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চামড়া খাতে গেল বছর পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ব জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকই চামড়াখাতে বেশি ঋণ দেয়। এর বাইরে সোনালী,রূপালী ও কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকও ঋণ দিয়ে থাকে। এ খাতের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী খেলাপি হওয়ায় ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ দিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান জানান, হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের বছর (২০১৭ সাল) থেকেই চামড়া শিল্পের রপ্তানি কমতে শুরু করেছে।
চামড়াখাতের (চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও জুতা) রপ্তানি আয়
অর্থবছর ২০১৩-১৪ ২০১৪-১৫ ২০১৫-১৬ ২০১৬-১৭ ২০১৭-১৮ ২০১৮-১৯
রপ্তানি আয় ১১২৪.১৭ ১১৩০.৫১ ১১৬০.৯৫ ১২৩৪.০০ ১০৮৫.৫ ১০১৯.৭৮
(হিসাব-মিলিয়ন ডলার, তথ্য সূত্র-ইপিবি)
তার মতে, একদিকে সাভারে অবকাঠামোর জন্য বিনিয়োগ, এই বিনিয়োগে পর্যাপ্ত পরিমাণ সহায়তা না পাওয়া এবং রপ্তানি আয় কমতে থাকায় চামড়া ব্যবসায়ীরা খেলাপি হতে শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, সেখানে চলতি বছরের জানুয়ারির আগে কেউ খেলাপি হয়ে থাকলে প্যাকেজের সুবিধা পাওয়া যাবে না। চামড়া শিল্পের জন্য খেলাপির সংজ্ঞা পরিবর্তন করে, ২০১৭ সাল থেকে যারা খেলাপি তাদেরকে প্রণোদনা সুবিধার আওতায় আনার অনুরোধ করেছেন তিনি। তাঁর আশঙ্কা, ব্যবসায়ীদের হাতে চামড়া কেনার পর্যাপ্ত টাকা না থাকলে গেল বছরের চেয়ে পরিস্থিতি ১০ গুণ খারাপ হতে পারে।
ট্যানারি মালিকদের সংগঠন ট্যানার্স এসোসিয়েশন এর সভাপতি শাহিন আহমেদ এর দাবী, তাদের জন্য আলাদা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা না করলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। তাদের হাতে থাকা ৫’শ কোটি টাকার রপ্তানি যোগ্য চামড়া এবং ঈদে যে চামড়া সংগ্রহ হবে তা রক্ষার জন্য এই সুবিধা প্রয়োজন। এটি বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উপর ভরসা না করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা।
সালমান এল রহমান বলেন, আর্থিকভাবে সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি প্রয়োজন হলে চামড়াখাত রক্ষায় বাজেট থেকে সহায়তা দিতে হবে। খেলাপি ঋণ পরিশোধে হাজারীবাগে ট্যানারি মালিকদের জমিগুলো বিক্রি কিংবা সেখানে বাণিজ্যিক কর্মকা- চালুর অনুমোতি দেয়া উচিত। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের পর ওই এলাকা রেড জোন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ফলে ওই জমি বিক্রি কিংবা সেখানে কোন স্থাপনা নির্মাণ করতে পারছেন না ট্যানারি মালিকরা।
চামড়াখাতে রপ্তানি আয়:
২০১৮ সালে বিশ্বে চামড়ার বাজার ছিল ৯৫.৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১২৮.৬১ বিলিয়ন ডলার। সম্ভাবনাময় এ খাতে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের মাঝেই সার্বিকভাবে কমছে চামড়াখাতের রপ্তানি আয়। সমাপ্ত প্রায় অর্থবছরেও যে চামড়াখাতের রপ্তানি আয় আগের বছরের তুলনায় কমবে তা ১১ মাসের হিসাবই বলে দিচ্ছে।
অর্থবছর ২০১৬-১৭ ২০১৭-১৮ ২০১৮-১৯ ২০১৯-২০ (জুন-মে)
আয় (মি./ড.) ১২৩৪ ১০৮৫.৫ ১০১৯.৭৮ ৭৩৯.৩৯
প্রবৃদ্ধি ৬.২৯% -১২.০৩% -৬.০৫% -২১.৬৬%
তথ্যসূত্র: ইপিবি (রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো)
চামড়া রপ্তানিতে ধ্বস:
চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে প্রক্রিয়াজত চামড়া রপ্তানিতে ধ্বস নেমেছে। ১১ মাসে প্রায় ৪১ শতাংশ কমে আয় হয়েছে ৯৩.৪৮ মিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের (২০১৮-১৯) একই সময়ে ছিল ১৫৮.১৮ মিলিয়ন ডলার।
জুতা রপ্তানি আয়:
চামড়াখাতের তিনটি উপখাত চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা বা জুতা। রপ্তানি আয়ের মধ্যে জুতার অবদানই প্রায় ৬০ ভাগ। এর আয় ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। তবে সমাপ্ত হতে যাওয়া অর্থবছরে এ খাতে বড় ধাক্কা আসবে। করোনার অভিঘাতে তৈরি হওয়া মন্দায় আসছে দিনগুলোতে জুতা রপ্তানি আয় কতটা বাড়বে তা এখনো অনিশ্চিত।
অর্থবছর ২০১৬-১৭ ২০১৭-১৮ ২০১৮-১৯ ২০১৯-২০ (জুন-মে)
আয় (মিলি./ডলা.) ৫৩৬.৯৬ ৫৬৫.৬০ ৬০৭.৮৮ ৪৩৬.৮৮
প্রবৃদ্ধি ৮.৫১% ৫.৩৩% ৭.৪৮% -২১.৬২%
তথ্যসূত্র: ইপিবি (রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো)
স্থানীয় বাজারে জুতার চাহিদা:
স্থানীয় বাজারেও চামড়ার জুতার চাহিদা বাড়ছে। মানুষের আয় বাড়ার সাথে সাথে জুতার ব্যবহার ও ফ্যাশন সচেতনা বেড়েছে। কদর বাড়ছে ব্র্যান্ডের জুতার। দেশে জুতার বাজারের আকার কমবেশি ৮ হাজার কোটি টাকা, যা বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। চামড়ার জুতার পাশাপাশি দামে কম ও টেকসই হওয়ায় কৃত্রিম চামড়ার (সিনথেটিক) জুতার চাহিদাও বাড়ছে। তবে চাহিদা অনুযায়ী এখনো চামড়া ও সিনথেটিক জুতা আমদানি হয়ে থাকে।
কাঁচা চামড়া রপ্তানি:
দেশের চাহিদা বিবেচনায় বাংলাদেশ কাঁচা চামড়া রপ্তানি হতো না। চামড়া যাতে পাচার না হয়ে যায় সেজন্য ঈদুল আযহার সময় সীমান্তে কড়া নজরদারিও থাকে। এ বছরও নজরদারি বাড়ানো হবে এবং দেশীয় খামারিদের সুরক্ষায় ভারত ও থেকে কোন গরু আমদানি করতে দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। গেল বছর চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ায় কাঁচা চামড়া (ওয়েট ব্লু) রপ্তানির সুযোগের দাবি ওঠে। অনুমোতি মিললেও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি।
চামড়া শিল্পে করোনার আঘাত:
গেল বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের তৈরি করা চামড়া খাতের রপ্তানি রূপরেখায় (দৃষ্টব্য-পৃষ্ঠা ১৩) এ খাতের রপ্তানি আয়ের দুটি প্রাক্কালন করা হয়েছে। প্রথম প্রাক্কলনে ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ২৩৪ কোটি ডলার (২.৩৪ বিলিয়ন ডলার) এবং ২০২৫ অর্থবছরে তা দ্বিগুণ করে ৫৫২ কোটি ডলার (৫.৫২ বিলিয়ন ডলার) করার আশা প্রকাশ করা হয়েছে। একই রূপরেখায় দ্বিতীয় প্রাক্কলনে এই লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ৫ বিলিয়ন ও ১৭.৪ বিলিয়ন ডলার ধরা হয়েছে। বাস্তবতা হলো প্রথম প্রাক্কলন থেকেই রপ্তানি আয় বহু দূরে। গেল অর্থবছরে রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। সমাপ্ত হতে যাওয়া অর্থবছরে এর পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারও হবে না। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে করোনার অভিঘাত। এতে চামড়াখাতের রপ্তানি আরো ক্ষতির মুখে পড়বে। কিভাবে মোকাবেলা করবে এই চ্যালেঞ্জ?
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয়:
খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রথমত ঋণ সহায়তা লাগবে। যেন যথা সময়ে চামড়া মজুদ করা যায়। এছাড়া চামড়া প্রক্রিয়জাতে ব্যবহৃত রাসায়নিক আমদানিতে শুল্ক তুলে দিতে হবে। এতে উৎপাদন খরচ কিছুটা কমবে। বাজেটে পাদুকা শিল্পের জন্য যে তিনটি উপাদান আমদানিতে শুল্ক কমানো হয়েছে তা খুব একটা প্রভাব ফেলবে না বলে তারা মনে করেন। বিটিএ’র সাবেক সভাপতি, প্রকৌশলী আবু তাহের বলেন, চামড়া রপ্তানিকে তৈরি পোশাকের মত কেন্দ্রীয় বন্ড সুবিধার আওতায় আনতে হবে। এতে খরচ অনেক কমে যাবে। উল্লেখ্য বর্তমানে ৩৫টি চামড়া রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধা পায়। সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি শাহিন আহমেদ জানান, বর্তমানে রাসায়নিক আমদানি ও ভ্যাট মিলিয়ে ২৭% থেকে ৩৫% করভার আছে। আমাদের দাবি এটি কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক।
কাঁচা চামড়ার দাম না পাওয়া:
চামড়া ব্যবসায়ীরা যেসব সুবিধা দাবী করছেন, তার বিপরীতে যারা চামড়া বিক্রি করেন তাদেরকে ধারাবাহিক ভাবে লোকসান গুনতে হচ্ছে। সব কিছুর দাম বাড়লেও উল্টো কমছে কাঁচা চামড়ার দাম। গেল সাত বছরে দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। গেল বছর দাম না পেয়ে চামড়া ফেলে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এতে নষ্ট হয়েছে দেশের সম্পদ। মৌসুমী ফরিয়া ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম বন্ধে ২০১৩ সাল থেকে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়ে আসছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে প্রতি বছরই দেখা গেছে শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত দাম মানছেন না ব্যবসায়ীরা। আড়তদারদের অভিযোগ সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও ট্যানারী মালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে ফেলে। অবশ্য এমন অভিযোগ বারবরই অস্বীকার করে আসছেন ট্যানারী মালিকরা।
সাল ২০১৩ ২০১৪ ২০১৫ ২০১৬ ২০১৭ ২০১৮ ২০১৯
গরু (বর্গফুট/ টাকা) ৮৫-৯০ ৭০-৭৫ ৫০-৫৫ ৪৫-৫০ ৪০-৫০ ৪৫-৫০ ৪০-৪৫
খাসি (বর্গফুট/ টাকা) ৫০-৫৫ ৩০-৩৫ ২০-২৫ ১৮-২০ ২০-২২ ১৮-২০ ১৮-২০
(তথ্য সূত্র: বাণিজ্যমন্ত্রণালয়)
সরকারিভাবে চামড়া কেনা:
এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গা কিংবা গেল বছরের মত অচলাবস্থা তৈরি হলে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চামড়া কেনার উদ্যোগ নেয়া যায় কিনা, এমন প্রস্তাবের কথা ওঠে আসছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। তবে এই ধরনের প্রস্তাবের বিপক্ষে মত দিয়েছেন বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফরউদ্দীন। শিল্পমন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স সভায় তিনি জানান, এই ধরনের উদ্যোগ চামড়া সংগ্রহে নতুন করে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। উল্লেখ্যে ঈদুল আযহার সময়ই চাহিদার সিংহভাগ চামড়া সংগৃহীত হয়।
স্বাস্থ্যবিধি মানা ও প্রশিক্ষণ:
করোনা প্রকোপে এবারের ঈদুল আযহায় ৪০ শতাংশ কম পশু কোরবানি হতে পারে। মহামারিতে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সচেতনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। করোনার ফলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া সংগ্রহ করা হয়তো সম্ভব হবে না। যারা পশু কোরবানি করবেন তাদেরকেই লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণে প্রশিক্ষণ দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সচেতনামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
লবণ নিয়ে যত কান্ড:
কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার প্রধান অনুসঙ্গ লবণ। প্রতি বছর ঈদুল আযহার আগে আগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ায়। এ বছর পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় লবণের কোন ধরনের সংকট তৈরি হবে না, বলে আগে ভাগেই জানিয়েছে দিয়েছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)। দেশে লবণের মজুদ আছে ২০ লাখ ৩ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমান মজুদকৃত লবণ দিয়েই আসন্ন ঈদুল আযহায় কোরবানির পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণসহ আগামী ১০ (দশ) মাস লবণের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। বছরে লবণের চাহিদা থাকে কমবেশি ১৯ লাখ মেট্রিক টন।
সিইটিপি কি প্রস্তুত:
গেল বছর পর্যন্ত সাভার চামড়া শিল্প নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি চালু না হওয়ায় ট্যানারিগুলো থেকে বর্জ্য ধলেশ^রীতে পড়তো। এ বিষয়ে পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকে বার বার সতর্ক করা হলেও কোন লাভ হয়নি। সিইটিপির মাধ্যমে ধলেশ^রী দূষিত হচ্ছে না বলে দাবী করেছেন বিসিকি চেয়ারম্যান মোশতাক হাসান। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী চামড়া সংরক্ষণে ৩০ হাজার লিটার পানি ব্যবহার করার কথা থাকলেও ঈদের সময় কাজ বেড়ে যাওয়ায় ট্যানারিগুলোতে ব্যবহার হয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার লিটার। অন্যদিকে সিইিটিপির ধারণ ক্ষমতা ২৫ হাজার লিটার।
নিজস্ব সিইটিপি:
সিইটিপি পুরোপুরি চালু না হওয়ায় সাভার চামড়া শিল্পনগরীর কয়েকটি বড় বড় ট্যানারি নিজস্ব সিইটিপি তৈরির উদ্যোগ নিলেও অনুমোতি দেয়নি বিসিসিক। পরিবেশ সম্মত চামড়া শিল্প নিশ্চিতে বিশ^ জুড়ে কাজ করে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি)। সংস্থাটির সনদ পেতে নিজস্ব সিইটিপি সহায়তা করবে। এই সনদ পেলে পরিবেশের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় রপ্তানি আয় বাড়ে। তবে এর বিরোধিতা করছেন সাভারের ট্যানারী মালিকরা। তারা মনে করেন, এই অনুমোতি দিলে কেন্দ্রীয় ভাবে নির্মিত সিইটিপি পুরোপুরি চালু হওয়ার কাজ থমকে যাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে ছোট ছোট ট্যানারি মালিকরা। সিইটিপি পুরোপুরি চালু হলেই কেবল নিজস্ব উদ্যোগে সিইটিপি’র অনুমোতি দেয়া যেতে পারে।
উন্মুক্ত স্থানে কঠিন বর্জ্য:
চামড়া প্রক্রিয়জাত করার আগে এর সাথে লেগে থাকা চর্বি, লেজ, শিং, কানসহ আরো কয়েক ধরনের বর্জ্য তৈরি হয়। হাজারীবাগে এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ থাকলেও সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে নেই। উন্মুক্ত স্থাে বর্জ্য ফেলায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন স্থানীয়রা। বৃষ্টির পানির সাথে মিশে বর্জ্য যাচ্ছে ধলেশ^রীতে। ডাম্পিং এর জন্য তিনটি জায়গা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুটির কাজ দ্রুত শেষ হবে বলে আশা করছে বিসিকি। এদিকে, কঠিন বর্জ্য থেকে হাঁস মুরগির খাবার না তৈরির জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও অভিযোগ আছে ট্যানারী পল্লী থেকে রাতের আঁধারে বর্জ্য চুরি হচ্ছে।
সাভারে শ্রমিকদের দুরদশা:
সাভারে পরিকল্পিত চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তুললেও শ্রমিকদের জন্য কোন সুযোগ সুবিধা রাখা হয়নি। এ প্রসঙ্গে ট্যানারি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাভারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার কোন কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো নানা অযুহাতে গত তিন বছরে ৮ হাজারের মত শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। অনেক ট্যানারি মালিক তাদের ছোট ছোট ট্যানারিগুলো বড় ট্যানারি মালিকদের কাছে সাব কন্ট্রাক্ট দিয়েছে। এর ফলেই শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা বাড়ছে।
আরেকটি চামড়া শিল্পনগরী:
সাভারে চামড়া শিল্প নগরীর পাশেই আরো একটি শিল্প নগরী গড়ে তোলার জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। হাজারীবাগের যেসব ট্যানারি প্লট পায়নি তাদের সেখানে সুযোগ দেয়া হবে। পাশাপাশি সুযোগ পাবে নতুন উদ্যোক্তারা। এছাড়া ট্যানারি সংশ্লিষ্ট রাসায়নিক ব্যবসাও হাজারীবাগ থেকে সাভারে সরিয়ে আনার পরিকল্পনা আছে। সেই সাথে কাঁচা চামড়ার আড়ত পুরান ঢাকার পোস্তা থেকেও এখানে সরিয়ে আনা হবে। ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে আরো একটি চামড়া শিল্পনগরী স্থাপনেও পরিকল্পনা আছে।
চামড়া আমদানি:
রপ্তানির পাশাপাশি বাংলাদেশ চামড়া আমদানিও করে। রপ্তানিকারকরা জানান, যে পদ্ধতিতে চামড়া প্রক্রিয়াজত করা হয় তা স্বাস্থ্য সম্মত না হওয়ার অভিযোগ এনে, অনেক বিদেশি ক্রেতা তাদের পছন্দমত দেশ থেকে চামড়া আমদানির শর্ত জুড়ে দেয়। ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার স্বার্থে শর্ত মানতে বাধ্য হন তারা। তবে সাভারের পরিবেশ সম্মত চামড়া শিল্পনগরীর ব্র্যান্ডিং করতে পারলে এই সমস্যা কেটে যাবে।
বাজেটে চামড়া শিল্প:
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানান, চামড়া শিল্পে প্রত্যক্ষভাবে ৬ লাখ ও পরোক্ষভাবে ৩ লাখ মানুষ জড়িত। এ খাতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো ও রপ্তানি সম্প্রসারণের জন্য চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উন্নয়ন নীতিমালা ২০১৯ প্রণয়ন করা হয়েছে। চামড়া খাতে রপ্তানি রূপরেখা প্রণয়নের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশকে ক্রমান্বয়ে আরো বৃহত্তর পরিসরে অঙ্গীভূত (াধষঁব পযধরহ রহঃবমৎধঃরড়হ) করার লক্ষ্যে পদক্ষে নেয়া হয়েছে।
চামড়া শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ:
২০১৯ সালে চামড়াখাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৫১.৯ মিলিয়ন ডলার। তাইওয়ান থেকে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ, পরিমাণ ৩১.৮ মিলিয়ন ডলার। উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে আছে হংকং, নেদারল্যান্ড, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান। গেল বছর খাত ভিত্তিক সর্বোচ্চ ১০টি শিল্পের মধ্যে চামড়ার অবস্থান ছিল নবম। একই সাথে গেল বছর প্রতিশ্রুত বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪৪১.৪৬ মিলিয়ন ডলার। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক)
চামড়া শিল্পে স্থানীয় বিনিয়োগ:
স্থানীয় ভাবেও চামড়া শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ২৮.৬৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্থানীয় ভাবে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৫ কোটি টাকার বেশি। (সূত্র: অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯)
চামড়া শিল্পের কর্পোরেট কর:
তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ক্ষেত্রে সাধারণ কারখানার জন্য কর্পোরেট কর ১২ শতাংশ এবং পরিবেশ সম্মত কারখানার জন্য ১০ শতাংশ। অথচ চামড়া সম্ভাবনাময় খাত হলেও তৈরি পোশাকের মত করপোরেট কর সুবিধা নেই। এবারের বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩২.৫ শতাংশ করা হয়েছে। চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তা প্রকৌশলী আবু তাহের বলেন, এই শিল্পে করপোরেট করহার কমানো উচিত।
আরো কিছু উদ্যোগ:
রপ্তানি পদ্ধতি সহজীকরণের লক্ষ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে Registered Exporter System (REX) চালু করা হয়েছে। এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকরা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিবর্তে নিজেরাই পণ্যের উৎস বিষয়ে statement of origin জারি করতে পারছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৭ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে সরকার ৬,৮২৫ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪ হাজার কোটি টাকা। চামড়াজাত পণ্য ও জুতা ১৫ শতাংশ হারে এবং চামড়া রপ্তানিতে ১০ শতাংশ হারে প্রণোদনা পেয়ে থাকে। বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়ন ও রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের সাথে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যিক চুক্তি ও দ্বি-পাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এর ফলে চামড়াখাত উপকৃত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
লিখেছেন: ফরহাদ হোসেন, সদস্য, ইআরএফ।