করোনা কি আদতেই করুন ঘেরাটোপে জড়িয়ে আনলো তৈরি পোশাক খাতকে। দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা পোশাক খাতকে ঘিরেই সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তা। অগ্র-পশ্চাত মিলে এই খাতকে ঘিরে চলছে ৪ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা। সেখানে কতটা টানা পোড়েন পড়তে যাচ্ছে। ৪০ লাখ শ্রমিক, তিন প্রজন্মের হাজারো উদ্যোক্তা কোথায় যাবে? পোশাক খাতে বছরের লেন-দেন ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে ব্যাংক বীমা, পরিবহন খাতের একটা বড় অংশই চলে পোশাক খাতকে কেন্দ্র করে। অর্থনেতিক এই বিশাল কর্মযজ্ঞের কী হবে?
বৈশ্বিক মহামারি করোনার করাল থাবায় এরকম গোটা চারেক মোটা প্রশ্ন এখন সাধারণ জিজ্ঞাসায় পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞ-অনভিজ্ঞদের জবাবও মোটামুটি রেডি। ভারিচালে বলে দিচ্ছেন ‘এইবার শ্যাষ’। বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা পতনমুখী। এই প্রবণতা ছাপিয়ে আবার কাটতির বাজার তৈরি না হলে এ পতনই শেষ পরিণতি। বিশেষজ্ঞদের মুখে এরকম জ্ঞান-গর্ভ বিশ্লেষণী জবাব অনেক শোনা যাচ্ছে। এদের কারো ভাবনা-বক্তব্যই অমূলক নয়। বাংলাদেশের পোশাক খাতের গত চার দশকের ইতিহাসে এত বড় অনিশ্চয়তা আর নেমে আসেনি।
তবে চাইলে স্বর্গ আর নরকের মধ্যেও মিল খুঁজে বের করে আনাও কিছু কঠিন কাজ নয়। সেরকম একটি প্রচেষ্টা থেকে বলা যায়, করোনায় করুন-কাতরতার কিছু নেই। কারণ,করোনায় কদর কমবে না। বরং উল্টো বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের জন্য আর্শিবাদ কুড়িয়ে আনতে পারে মরার এই করোনা।
কীভাবে? কত-শত কারণের কথাই বলা যাবে।-এর মধ্য থেকে মোটা দাগের গোটা চারেক কারণের কথা বলা যাক। প্রথমত, করোনার মনুষ্য না প্রকৃতির সৃষ্টি এ নিয়ে বিতর্ক আছে। আধিপত্য বিস্তারের কৌশলের অংশ হিসেবে নতুন ধরনের জীবানু অস্ত্র নিজেদের বাগানে চাষের কড়া অভিযোগ আছে চীনের বিরুদ্ধে। শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসী এই অভিযোগ অসত্য মনে করেন না। এছাড়া মারনব্যধি এই করোনা সংক্রমনের আদি উৎস যে চীন- তা তো কেউ অস্বীকার করেনা। ফলে চীনের প্রতি সারা বিশ্বের নেতিবাচক মানসিকতা আরো তীব্র হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এটা একটা বড় সুযোগ।পরিকল্পনা করে এগুলে এবং স্বাভাবিক উৎপাদনে ফিরতে পারলে বাংলাদেশের জন্য এটা মোক্ষম মওকা।
আবার করোনার কারণে পণ্য তালিকায় যুক্ত হয়েছে সুরক্ষা পণ্যের সুবিশাল বাজার। অন্যান্য পোশাকের মূল ভোক্তা পশ্চিমারা। তবে করোনা পণ্যের খদ্দের অমল-ধবল গোটা আদম দুনিয়া। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেছেন জাত বেনিয়া পশ্চিমারা। জার্মানির বৈদেশিক বাণিজ্য সহায়কমন্ত্রী ড. মুলার বলেছেন, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) রপ্তানির বিশাল বাজারের হাত ছানি এখন বাংলাদেশের সামনে। বিভিন্ন ধরনের পিপিই, ফ্যাশনেবল মাস্ক, হাত মোজা, শেল্ড, গগলস ইত্যাদি। এছাড়া সব ধরনের পোশাকেই করোনাসহ অন্যান্য জীবানুরোধী করে উতপাদন করা যেতে পারে। জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ইতিমধ্যে করোনারোধী ফ্যাব্রিক্স রপ্তানি শুরু করেছে। সাধারণ রপ্তানি পোশাকের তুলনায় এসব পণ্যে মূল্য সংযোজনেরও সুযোগ বেশি। ১ ডলারের টি শার্টের তুলনায় কয়েকগুন দামে রপ্তানি হতে পারে এক একটি মাস্ক। অ্যাডাম অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল হক মুকুল কথা প্রসঙ্গে জানান, বিশ্বব্যাপী করোনার সংক্রমণ পিপিইর বড় বাজার তৈরি করেছে। করোনার শুরুর দিকেই ফ্রান্সের একটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান তাকে পিপিই সরবরাহের অনুরোধ জানিয়েছে। ওই ব্র্যান্ড বলেছে, চার্টার বিমানে ফেব্রিক্স পাঠিয়ে দেবে। দেশে কারখানা বন্ধ থাকায় তখন অফারটি নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে দেড় লাখ পিস পিপিই নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ফ্রান্সের আরো কয়েটি প্রতিষ্ঠানকে পিপিই সরবরাহ করেছেন তিনি। আয়ারল্যান্ডের আরও কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে তার কথা হচ্ছে। টেক্স ওয়েভের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিনও প্রায় অভিন্ন কথা বলেছেন। পিপিইর পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যের তালিকায় নানা রকম ফ্যাশনেবল মাস্ক যুক্ত হওয়ার কথা জানান তিনি। আরো বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে করোনা পণ্যের বাজার সম্ভাবনার কথা জানা গেল। পিপিই উৎপাদনে কিছুটা ব্যয়বহুল প্রযুক্তি এবং অবকাঠামো প্রয়োজন। তবে মাস্ক উৎপাদন অতি সাধারণ। গত কয়েক বছর ধরে যে সব কারখানা বন্ধ কিংবা উৎপাদনে নেই সে সব কারখানাও সামান্য বিনিয়োগে বিশ্বচাহিদার এই পণ্যের মাধ্যমে উতপাদনে ফিরতে পারে। পণ্য ডিজাইন, ক্রেতা তালাশ, বাজার এবং বিপনন নেটওয়ার্কটুকুতে সহায়তা করা হলে রাতারাতি চর দখলের মত করোনা পণ্যের বাজার দখলে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সামনে কোন বাধা নেই।
করোনা কেন আর্শিবাদের দ্বিতীয় কারণ হতে পারে পোশাকের মান। বাংলাদেশের পোশাক মানের দিক থেকে একেবারেই মৌলিক। চার দশক ধরে শুধু শার্ট, টিশার্ট, ট্রাউজার আর সুয়েটার বানিয়েই হাত পাকিয়েছেন উদ্যোক্তারা। পোশাক পণ্যের মোট রপ্তানি আয়ে এই চার পণ্যের অবদান প্রায় ৮০ শতাংশ। এই চার পণ্যের মধ্যে আবার টি-শার্টের প্রাধান্য নিরঙ্কুশ।
যুগের পর পর যুগ এই বৈচিত্র্যহীন চার পণ্যে নির্ভরতার সমালোচনাও সর্বত্র। বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা ঢাকায় প্রথম বাণিজ্য আলোচনা শুরু করেন এই সমালোচনা দিয়ে। মরন-বরণ বৈশ্বিক এই করোনা পরিস্থিতিতে এই দুর্বলতাই এখন মস্ত শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আর্থিক সংকটে ভোগ ক্ষমতা কমে বিশ্ব বাজারের চাহিদা এখন এই মৌলিক পোশাকেরই। করোনায় বৈশ্বিক থাবায় বিশ্ব শ্রমশক্তির ৮১ শতাংশই এখন কাজহীন বা বেকার। অর্থাৎ প্রতি ৫ জন শ্রমিকের মধ্যে ৪ জনের বেশি এখন কাজহীন। অনেক উদ্যোক্তাও উদ্যোগ-উদ্যোম হারিয়ে বিপন্ন অস্তিত্বের মুখে পড়েছেন। এই সংকট আরো প্রকট হতে পারে। যত প্রকটই হোক না কেন মৌলিক পোশাকের চাহিদা কখনোই কমবেনা। বরং বাড়বে। ফ্যাশনদুরস্ত বিলাসী পণ্যের ক্রেতাও পরিস্থিতির কারণে ভোগে মৌলিক পণ্যে নেমে আসবেন। মানব সভ্যতা টিকে থাকলে আড়স্ট অঙ্গ আড়ালের প্রাগৈতিহাসিক প্রচেষ্টা থাকবেই। একরম একটা উদাহরন অক্সফোর্ডের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র। অতিথীদের জন্য আসন, খাবার গ্রহনে নিয়ম মেনে চলতে বলা হয়েছে আমন্ত্রণ পত্রের নির্দেশিকায়। পোশাক অংশে (ড্রেস কোর্ড) বলা হয়, ‘এনি ড্রেস বাট মাস্ট।’ অর্থাৎ যেকোন পোশাক পরেই সমাবর্তনে আসা যাবে। কিন্তু উদম বা নেংটু-পুটু হয়ে আসা যাবে না। মানে, পোশাকের চাহিদা কোন দিন শেষ হবে না। তদুপুরি পরিসংখ্যান বলছে, কোন কঠিন কালেই কদর কমেনা বাংলাদেশের পোশাকের। যেমন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাকালে গত ২০১০-১১ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিকারক বাঘা বাঘা সব দেশ যেখানে কুপোকাত। সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সর্বকালের রেকর্ড প্রায় ৩৪ শতাংশ। রহস্য শক্তি একটাই। মোটা মান।
আর্শিবাদের অন্য কারণের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীন এবং ভারতের শুল্ক লড়াই। এই সুযোগে একক দেশ হিসেবে প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে ভিত আরো মজবুত হচ্ছে বাংলাদেশের। আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বাদে প্রায় সারা দুনিয়ায় শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে তৈরি পোশাক। পোশাক উৎপাদক বাংলাদেশের মূল প্রতিযোগি কোন দেশই এই সুবিধা পাচ্ছেনা। শুল্ক হারের হিসেব আমলে নিলে প্রতিযোগিদের তুলনায় গড়ে ২০ শতাংশ এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। করোনায় বাজার বাড়লে জ্যামিতিক হারে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধা পাওয়া যাবে।
চতুর্থত, চীন ছাড়া অন্যান্য সব দেশে বিনিয়োগ হয়েছে বিদেশি উদ্যোক্তারা হাতে। যেকোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এসব বিদেশি উদ্যোক্তারা তাদের তল্পি-তল্পা গুটিয়ে নিতে পারেন। এখানেও বাংলাদেশ এগিয়ে। উদ্যোক্তাদের প্রায় সবাই স্থানীয়। সৃজনশীল এসব উদ্যোক্তা বহুবার জাতীয় অনেক প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে টিকে থাকার কৌশল শিখেছেন। কাকে হাসি, কাকে কাশি কিংবা কাকে কোন হালুয়ায় ম্যানেজ করতে হয়-সেই শিল্পকলা প্রথম চালান রপ্তানির আগেই রপ্ত করেন তারা।
নইলে দেশে উৎপাদিত বলতে গেলে এক তোলা তুলা নেই, এক গাঁছি সুতা নেই, বোতাম নেই- আমদানি করা কাঁচামালেই পণ্য বানাতে হয়। আমদানিতে আছে মোটা অংকের ব্যয়। আছে কালক্ষেপন। গ্যাস-বিদ্যুত অবকাঠামো স্বল্পতা,আমলান্ত্রিক জটিলতা ও সরবরাহ চেইনের প্রায় সব খাতেই অনাহুত অদৃশ্য ব্যয়। সীমাহীন এই সীমাবদ্ধতা উতরিয়ে বিশ্ব আসরে দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন। ব্যাপারটা খোয়াবে দেখা নীল সাগর পাড়ি দিয়ে পলকেই ফুরফুরে পরীর দেশে পাড়ি দিয়ে ফেলা নয়। সর্বশেষ তথ্য, গেল পঞ্জিকা বছরেও দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক দেশের মর্যাদা অক্ষুন্ন আছে বাংলাদেশের। যদিও খুব কাছ থেকেই ঘাড়ে গরম নিশ্বাস ফেলছে ভিয়েতনাম।
এছাড়া তিন দফায় ২৭৭ শতাংশ হারে বেতন (মজুরি নয়) বাড়ানোর পরও এখনো তুলনামূলক স্বস্তায় শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে। ভৌগলিক কারণে এসব শ্রমিকের হাতের আঙ্গুল সুঁই সুতায় কাজ করার জন্য বিশেষ উপযোগি। এই সুবিধা কশ্মিনকালেও খোয়া যাবেনা। যুগপত এ সব শক্তি কাজে লাগিয়ে করোনাকে কল্যাণকর করা কঠিন কোন কাজ কি?
লিখেছেন: আবু হেনা মুহিব, সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক সমকাল
তথ্যসূত্র: আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুারো ইপিবি।
not so good