করোনা অর্থনীতিকে বিপর্যয়ে ফেললেও পরিবেশে এনেছে স্বস্তি। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষ করোনারা আতঙ্কে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী। বনে, জঙ্গলে, সাগর পাড়ে কমে গেছে কোলাহল। মানুষেরর উপোদ্রব কম থাকায় বিরল প্রাণিদের আবারো দেখা মিলছে। বাংলাদেশের কক্সবাজারের সৈকতে দেখা গেছে ডলফিনের অবাধ বিচরণ।
এক কথায় করোনা, প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের সঞ্জার করেছে। তবে দুর্বল নজরদারীর সুযোগে চোরা শিকারী, প্রাণি পাচার, অবৈধ মাছ আহরণ এবং অন্যান্য পরিবেশ বিষয়ক অপরাধও বেড়েছে। খাবারের সন্ধান, প্লাষ্টিক ও মেডিকেল বর্জ্য পরিবেশ দূষণে বেশি দায়ী। করোনা পরবর্তী এসব দূষণ আরো বাড়ার আশঙ্কাই করা হচ্ছে।
করোনা চলে গেলে আবারো প্রকৃতির উপর মানব অত্যাচার আবারো বাড়বে। সেটা যেন না হয় এবং নতুন স্ফুটিত সবুজকে ধরে রাখতে আমাদের চেষ্টার পাশাপাশি কৌশল নিতে হবে। এই চেষ্টা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। তবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনটা জরুরী, প্রকৃতির সুরক্ষা নাকি অর্থনীতি পুনরুদ্ধার? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতিকে সুরক্ষা দিয়েই অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।
তারা বলছেন,প্রকৃতিকে সুরক্ষা দিয়ে বিনিয়োগ করতে পারলে কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে তেমনি লাভজক হবে ব্যবসাবাণিজ্যও যা অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। ভবিষ্যতের বড় দুর্যোগ মোকাবেলায় বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্চা দেয়ার চাইতে আগে ভাগেই পরিবেশ সম্মত বিনিয়োগ করা কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়? এমন প্রশ্ন রাখছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। করোনা পরবর্তী প্রকৃতির সবুজকে ধরে রাখতে তারা ছয়টি পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন।
বায়ুর মান বাড়ানো ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা
বিশ^ জুড়েই লকডাউনের ফলে বায়ু ও শব্দ দূষণ অনেক কমে গেছে। বাতাসের এই মান ধরে রাখার জন্য পরিবহন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা যেতে পারে। যান্ত্রিক পরিবহনের চেয়ে অযান্ত্রিক পরিবহন উৎসাহী করা উচিত। এই যেমন, ইউরোপের দেশ কলম্বিয়ার বোগোটা ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে নগরবাসীদের হেঁটে চলা ও বাইসাইকেলের জন্য আলাদা লেন করে দেয়া হয়েছে। এতে বায়ু ও শব্দ দূষণ কমার পাশাপাশি নিরাপদ ভ্রমণ ও স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে বিশে^র সরকারগুলো চাইলে এখনই নীতি বদলিয়ে, প্রণোদনা ও বিনিয়োগ বাড়িয়ে টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্ন জ¦ালানি ও সবুজ নগরায়ন গড়ে তুলতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোতে পানের জন্য সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের জন্য প্রয়োজনীয় পানির সংকটে আছে লাখ লাখ মানুষ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য এটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। করোনা কালে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের জন্য জরুরী ভিত্তিতে পানিরর ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বার বার হাত ধোয়া নিশ্চিত হয়। অন্যদিকে অস্থায়ী ল্যাট্রিন এর ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সঠিক নীতিমলা বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে, দূষণ ন্যুনতম মাত্রায় হয় এবং রোগব্যাধি না ছড়ায়। মানব দেহ ও প্রাকৃতিকে সুরক্ষা দিতে পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন সুবিধা ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন মধ্যমেয়াদী বিনিয়োগ।
বন্যপ্রাণি সুরক্ষা ও বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা
বন্যপ্রাণি পাচার বন্ধ করা, চোরা শিকারীদের তৎপরতা বন্ধ ও প্রাণীর আবাস সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকারকগুলোকে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি বাড়তি বনপ্রহরী নিয়োগ দেয়া ও তাদের পারিশ্রমিক দেয়ার জন্য আলাদা তহবিল গঠন করা যেতে পারে। এছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়েও বনকে সুরক্ষিত করা যায়। যেমন- বনে অনেক নিরাপত্তা ক্যামেরা বসিয়ে ও ড্রোন ক্যামেরা ব্যবহারের মাধ্যমে নজরদারী বাড়ানো যায়। এতে করোনা কালে সামাজিক দূরত্বও যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি দুর্বল নজরদারীও ঘুচানো যাবে। এর সাথে বনে জঙ্গলে আগের মত পর্যটকদ প্রবেশ নিরুৎসাহিত করতে বিধিনিষেধ জারি করা যেতে পারে।
বন্যপ্রাণির অবৈধ বাণিজ্য বন্ধে এশিয়ার দেশগুলো সরব হচ্ছে। বেআইনী বাজার বন্ধেও এই অঞ্চলের মানুষের সমর্থন বাড়ছে। চীনের অনেক প্রদেশে বন্যপ্রাণির অবৈধ বাজার বন্ধে স্থানীয়দের বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরিতে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। পশুসম্পদ বাড়ানো, চা চাষ ও হারবাল ওষুধ উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহী করা হচ্ছে। বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষায় নদী দূষণ রোধ ও ক্ষতিকর বালাই দমনে স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা উচিত। এ লক্ষ্যে উৎসাহে প্রদানে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে।
খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নগর কৃষিকে উৎসাহী করা
করনোয় সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় শহরে কৃষির প্রয়োজনীয়তা ও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। যে কোন শহরের চাহিদার ১০ ভাগ ফল ও শাকসবিজর যোগান এবং ১৫ ভাগ সবুজায়ন স্থানীয় ভাবেই করা সম্ভব। এ সংক্রান্ত বিনিয়োগ বাড়ালে প্রতি ৫০ জনে একজনের কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ আছে। কৃষি সংক্রান্ত ই-কমার্সের প্রসারেও এটি সহায়তা করবে। এই ধরনের কৃষি উৎপাদন ভোক্তাদের খরচ কমানোর পাশাপাশি জ¦ালানির ব্যবহার ও দূষণ কমিয়ে আনতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ইতিমধ্যে এই ধরনের উদ্যোগ শুরু হয়ে গেছে। করোনা মহামারির মধ্যেই স্থানীয় কৃষক ও উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণে এ সংক্রান্ত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সিঙ্গাপুর। এই কর্মসূচির লক্ষ্য হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে শহরগুলো নিজস্ব কৃষি পণ্যের চাহিদার অন্তত ৩০ ভাগ নিজেই মিটাবে।
সবুজ প্রকৃতিতে জীবন যাপনের জন্য বিনিয়োগ করুন
এই ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশগুলো কর্মসংস্থান সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারে এবং পুনরুদ্ধার করতে পারে অর্থনীতিকে। পরিবেশ সুরক্ষা দিয়ে করা ব্যবসাকে ডিজিটাল অবকাঠামো কিংবা ই-কমার্স দিয়ে সহায়তা করা যেতে পারে। বেকারত্ব ঘুচাতে পরিবেশ সম্মত কর্মসংস্থানের জন্য যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। জীবনযাপন পাল্টাতে সবুজের ভূমিকা বাড়ানোর কথা বলছেন তারা। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছেন, পাকিস্তানে ১০ বিলিয়ন (১ বিলিয়ন=১০০ কোটি) বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচির কথা। শহরে সবুজ বাড়াতে পারলে কিংবা প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনতে পারলে পর্যটন ব্যবসারও চাহিদা তৈরি হবে।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগীর অঞ্চলের বেশির ভাগ ব্যবসা উদ্যোগই ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি আকারের। এসব প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশ সম্মত প্রযুক্তি তৈরি ও ব্যবসার মডেল তৈরির জন্য আর্থিক ও কারিগরী সহায়তা করতে হবে। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে এদের সাথে যুক্ত করে দিতে পারলে, বড়দের কাছ থেকে ছোটরা সাহায্য নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে। অন্যদিকে টেকসই ও পরিবেশ সম্মত এবং সবুজের সমারোহ আছে শিল্প স্থাপনা পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম হতে হবে
গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডপটেশন এর এক প্রাক্কলন বলছে, দুর্যোগ মোকাবেলায় ২০২০ থেকে ২০৩০ এই এক দশকে বিশ^ব্যাপী ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। এতে দুর্যোগ জনিত ক্ষতি আগে ভাগেই প্রশমিত হবে। ফলে ৭.১ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ সুরক্ষা পাবে। পাশাপাশি বড় ড় অবকাঠামোতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে তা যেন বাস্তুতন্ত্রের জন্য হুমকি না হয়, মিতব্যয়ী হয় কার্বন নি:সরণে এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দুর্যোগ মোকাবেলায় টেকসই হতে পারে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকাতে প্রাকৃতিক ভাবেই সুরক্ষা বলয় তৈরি করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রবাল সংরক্ষণ কিংবা সমুদ্র উপকূলে ম্যানগ্রোভ বন বাড়ানোর জন্য বনায়ন কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। লবণাক্তসহনশীল কৃষি উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহী করতে হবে। এসব কার্যক্রম শুরু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতেও তৈরি হবে কর্মচাঞ্চল্য।
পরিবেশ সুরক্ষায় বিনিয়োগে দরকার উদ্ভাবনী অর্থায়ন
প্রকৃতির সবুজ ফিরিয়ে আনতে যে বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে, তা পূরণে প্রচলিত অর্থায়ন যথেষ্ট নয়। এজন্য উদ্ভাবনী অর্থায়ন লাগবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃতিকে সুরক্ষা দিয়ে ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে এমন শিল্পখাতের অর্থায়নের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ড ছাড়তে পারে। এক্ষেত্রে কোরিয়ার এক্সপোর্টে ইমপোর্ট ব্যাংক এর ’গ্রিন রিকভারি’ উদ্যোগ ভালো একটি উদাহরণ।
প্রকৃতি সুরক্ষায় কর, বিভিন্ন ফি ও জরিমানা বাড়ানোর মাধ্যমে বিশে^র সরকারগুলো রাজস্ব আয় বাড়াতে পারে। অন্যদিকে টেকসই ও কার্বন নি:সরণ কম হবে এমন বিনিয়োগে উৎসাহ দেয়া যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশ, দূষণ ঠেকাতে কার্বন ট্যাক্স চালু করছে। পরিবেশ সম্মত শিল্প উদ্যোগে দেয়া হচ্ছে কর ছাড় ও প্রণোদনা। এসব উদ্যোগ করোনা পরবর্তী বিশে^ প্রকৃতির সবুজ ধরে রাখা ও তা ধূসর হওয়া থেকে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
এডিবি’র ব্লগ অবলম্বনে লিখেছেন ফরহাদ হোসেন।
(মূল: ব্রুস ডান, পরিচালক, এডিবি ও ইরিন সিনোগবা, পরামর্শক, এডিবি)