এ বছরের জাতীয় বাজেট একটি ভিন্ন এবং সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থিত হয়েছে। বিদ্যমান সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা গুলোর পাশাপাশি যোগ হয়েছে চলমান করোনাভাইরাস ঘটিত মহামারি, যা নিয়ে সরকারকে বাজেট পূর্ববর্তী সময়ে বিশেষভাবে ভাবাচ্ছে। অভূতপূর্ব এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাই সরকারকে বিভিন্ন অগ্রাধিকার বিভিন্ন জরুরি ভিত্তিতে চিহ্নিত করে এই বিশেষ সময়ের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।
বাজেটের অগ্রাধিকার নিরূপণ করার জন্য প্রথমেই করোনা সংকটের আর্থসামাজিক প্রভাব এবং ব্যাপ্তি বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে। প্রথমত, করোনা একটি স্বাস্থ্য সংকট যা কিনা প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে এবং আগামী অর্থবছরের অন্তত: বেশ কিছু সময় জুড়ে এই চাপ অব্যাহত থাকবে। এই সংকট মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা যোগ হবে।
আমাদের অর্থনীতিতে করোনা এবং তা নিয়ন্ত্রণে লকডাউনের প্রভাব ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে। দেশি ও বিদেশি অনেক বিশ্লেষণে প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, বাণিজ্য, ও রাজস্ব কমবে বলে ধারণা করা হয়েছে। আগামীর জাতীয় বাজেটে এসব আর্থ-সামাজিক সংকট সমাধানের দিকনির্দেশনা এবং সহায়তা থাকতে হবে। অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি গুলোর দুর্বলতার সঙ্গে আরো যে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, প্রণোদনা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সামাজিক সহায়তার জন্য ব্যাপক ব্যয় বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা এবং সেই সাথে রাজস্ব আহরণে ধ্বস।
স্বাস্থ্য ও জীবিকার সঙ্কট, ব্যয় বৃদ্ধি, আয়ে ধ্বস এবং মধ্যমেয়াদে অর্থনীতির সংকোচন- এসব কঠিন বাস্তবতা বিবেচনায় নতুন বাজেট সামনে আনতে হবে। কিন্তু এসব সংকট ব্যবস্থাপনায় কী করতে পারে বাজেট? অগ্রাধিকারমূলক খাতগুলোর প্রয়োজনীয় বরাদ্দের মাধ্যমে বাজেট অর্থ সহায়তার পাশাপাশি নীতি সহায়তারও ইঙ্গিত বহন করবে। কিন্তু এই কঠিন সময়ে সংকট মোচনে সীমিত সম্পদের ব্যবহার ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার কৌশল ও বাজেট সম্পূরক হিসেবে কাজ করবে এবং সেই আঙ্গিকেই বাজেটের অগ্রাধিকার প্রণয়নে জোর দিতে হবে।
করোনা সংকট বাংলাদেশে আঘাত করার প্রায় চার মাসের মাথায় এই বাজেট উপস্থাপিত হতে চলেছে। সবাই আশা করেছিলেন, এই সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল বা অন্তত তার প্রাথমিক পর্যায় প্রণীত হবে এবং ২০২০-২০২১ সালের বাজেট সেই কৌশলের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হবে। যদিও সরকার খুব দ্রুত প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু আমরা এখনও পুনরুদ্ধার কৌশল প্রণয়ণ দেখতে পাইনি। সুতরাং সংক্রমণের ঝুঁকি ও লকডাউনের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুরবস্থা মোকাবেলায় আগামী বাজেট হয়তো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে। কিন্তু মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে যেসব পদক্ষেপ এখন নেওয়া প্রয়োজন, সেগুলোর বিষয়ে নতুন বাজেটে কতটুকু প্রতিফলিত হবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা জোরদার করা সংকট কাটানোতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। কর্মসংস্থান, রপ্তানি ও রেমিটেন্সে যে ধ্বস নামবে তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সাহসী রাজস্বনীতি প্রণয়ন খুবই জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। সে জন্য নীতিনির্ধারকদের বিগত বছরগুলোর রক্ষণশীল বাজেট ঘাটতি ব্যবস্থাপনা কৌশল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আগামী দুটি অর্থবছরে ৭ থেকে ৮ শতাংশ বাজেট ঘাটতি রাখা যেতে পারে।
কর্মসংস্থান হ্রাস বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে অন্যতম। অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে আনা এবং চাহিদার ভিত্তিতে কর্মসংস্থান রক্ষা ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। আগামী বাজেটে এই বিষয়টির প্রতিফলন তাই অত্যাবশ্যকীয়।অন্যদিকে কর্মসংস্থান ধরে রাখার জন্য নিয়োগকারীদের মজুরি সুরক্ষা সহায়তা /প্রণোদনা দেওয়া দরকার। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপুল জনগোষ্ঠী চাকরি হারানোর শংকায় আছে যা বাংলাদেশের উন্নয়ন, বিকাশ এবং দারিদ্র্য বিমোচনকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে।
বর্তমান সংকট মূলত একটি স্বাস্থ্য সংকট। এই সংকট এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আনা গেলে অর্থনীতি সচল করা কঠিন হবে। জীবন ও জীবিকা দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যখন জীবন হুমকিতে থাকে, জীবিকার বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়। সেজন্য স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আগামী বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব পেতে হবে। তাই চলমান সংকট থেকে বের হয়ে আসার জন্য স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। জিডিপির অন্তত: ২ শতাংশ এই খাতে বরাদ্দ দিতে হবে।
স্বাস্থ্য খাতের পাশাপাশি দুটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে নজর দিতে হবে। বর্তমান সংকট মোকাবিলায় স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে এবারের বাজেট থেকেই কাজ শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ। লকডাউনের কারণে সৃষ্ট উৎপাদন ও যোগান ব্যবস্থা এবং সামাজিক খাতে যে ব্যঘাত ঘটেছে, সেরকম সংকট ভবিষ্যতে মোকাবেলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাত যেমন শিক্ষা, প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানো জরুরি এবং বাজেট এই বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারে।
সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে এবং জোরালো করতে কর্মসংস্থান, এসএমই, কৃষি এবং সেবা খাতে চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনা জরুরি। লকডাউনের কারণে সৃষ্ট সংকটের প্রভাব হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ কর্মসংস্থান ও ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি কমে পেতে পারে। একটি স্থানীয় পরামর্শক সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী এসএমইতে ৫০ ভাগ পর্যন্ত কর্মী ছাটাই করতে পারে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে টেকসইভাবে গতি ফিরিয়ে আনতে গেলে বিনিয়োগ ও রপ্তানি বহুমুখীকরণে গতি আনার বিকল্প নেই। বিনিয়োগ পরিবেশের সংস্কার, বাণিজ্য সহায়ক নীতি ও অবকাঠামো এবং নতুন রপ্তানি খাতের বিকাশে মান এবং উৎপাদনশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ আগামী বাজেটে রাখতে হবে।