করোনা সঙ্কটকালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দু’টো বিষয় বড়ই মূখ্য। একটি হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখা এবং অন্যটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখা। প্রায়শ:ই দু’টো বিষয়কে একে অন্যের বিপরীতে উপস্হাপন করা হচ্ছে। সঙ্কটের কারনে, অর্থনৈতিক মন্দার কারনে এবং সম্পদের অপ্রতুলতার কারনে অনুমিত হচ্ছে যে দু’টোই এক সঙ্গে অর্জিত হতে পারবে না। সেই সঙ্গে প্রচ্ছন্ন অনুমান হচ্ছে যে বিষয় দুটো পারস্পরিক দ্বন্দ্বমূলক – এর একটিকে বেছে নিতে হবে অন্যটির বিপরীতে। সুতরং স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে কোনটি আমরা করবো দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বাঁচাবো, না অর্থনীতিকে বাঁচাবো।
আমার মনে হয় বিষয়টিকে একটি ভ্রান্তিমূলক প্রেক্ষিত থেকে উপস্হাপন করা হচ্ছে। বিষয়টি ‘কোনটিকে বাদ দিয়ে কোনটি করবো’ নয় – দুটোই করতে হবে। প্রশ্নটি হচ্ছে অগ্রাধিকারের – কোনটি এ মুহূর্তে করতে হবে এবং কোনটি তার পরে করতে হবে। বিষয় দু’টো পরস্পর বিরোধী নয়, বিষয় দু’টো পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে প্রয়োজন – ‘মানুষ বাঁচানোর’। এ সঙ্কটকালে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন। তাঁদের কোন কাজ নেই, তাঁদের কোন আয় নেই, ঘরে তাঁদের খাদ্য নি:শেষিত। তাঁরা ‘দিন এনে দিন খান’ – নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখার মতো তাঁদের কোন সঞ্চয় নেই। এ মুহূর্তে তাঁদের জন্য দু’টো জিনিষ করা অত্যাবশ্যকীয় – তাঁদের খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা এবং তাঁদের নগদ অর্থ প্রদান। যেমন, প্রতিটি মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় পরিমান চাল ও ডাল দেয়া যেতে পারে। বর্তমানে স্হিত নানান কাঠামো ব্যবহার করে তা করা যেতে পারে। জানি, নানান দুর্নীতির কথা সেথখানে উঠবে। সেনাবাহিনীকে কি এ ব্যাপারে ব্যবহার করা যায় না?
নগদ অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্হাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। এক, দেশে প্রচলিত বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও অন্যান্য ভাতার মাধ্যমে নগদ অর্থায়ন বাড়ানো যেতে পারে। এখন এ সব ভাতার পরিমান জনপ্রতি ৫০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। এ সবের পরিমান ৫০০০ টাকায় উন্নীত করা দরকার। এর বাইরেও অন্যান্য দু:স্হ জনগোষ্ঠীকে অর্থায়নের জন্যে নানান কাঠামো ব্যবহার করা যায়। এর জন্যে একটি অগ্রাধিকার তহবিল এখনই বাস্তবায়ন করা দরকার।এর জন্যে প্রয়োজনীয় কাঠামো ও প্রক্রিয়া গড়ে তোলা প্রয়োজন।
সুতরাং সাম্প্রতিক সময়ে তাৎক্ষণিকভাবে স্বল্প মেয়াদে পুরো নজর দিতে হবে – ‘মানুষ বাঁচানোর’ জন্যে। এর আর কোন বিকল্প বর্তমান মুহূর্তে নেই। এটাই এ সময়ে আমাদের ধ্যান-জ্ঞান হওয়া প্রয়োজন।
‘মানুষ বাঁচানোর’ সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি দিতে হবে মধ্য মেয়াদে ‘অর্থনীতিকে বাঁচানোর’। এর মূল লক্ষ্য হবে অর্থনৈতিক পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন। এর নানান উপাংশ থাকতে পারে। এক, অতি দ্রুত কৃষির নানান উপকরণ – যেমন, সার, বীজ, জল – কৃষকের কাছে পৌঁছানো। তাঁদের জন্যে সহজ ঋণের যোগান। দুই, ক্ষুদ্র ও মধ্যম শিল্পের জন্যে প্রণোদনা। এবং, তিন, বড় শিল্পকে সহায়তা প্রদান।
এ সব ক্ষেত্রে তিনটে বিষয়ের ওপরে জোর দিতে হবে। এক, আমাদের রপ্তানীযোগ্য সামগ্রীর ওপরে – যেমন, পোশাক শিল্প বা জনশক্তির – ওপরে বিশেষ নজর দিতে হবে। দুই, লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কৃষি বা ক্ষুদ্র শিল্পের জন্যে বরাদ্দকৃত অর্থ কায়েমী স্বার্থবাদীদের দ্বারা কুক্ষিগত না হয়, এবং তিন, দুর্নীতি রোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে এখনই মনোযোগ দিয়ে এ সব প্রতিহত করার জন্যে মোর্চা গঠন করতে হবে।
তবে শঙ্কা রয়েছে দীর্ঘ মেয়াদও। এ সঙ্কটের একটি অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হয়তো হবে প্রকট খাদ্য সঙ্কট বিশ্বব্যাপী। এর মধ্যেই বলা হচ্ছে যে বিশ্বে ২৫ কোটি লোক দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত হতে পারেন। আমাদের দেশেও ভবিষ্যত খাদ্য সঙ্কট এড়ানোর চিন্তা-ভাবনা এখনই হওয়া দরকার। আমাদের কৃষি ব্যবস্হা আমাদের খাদ্য চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা রাখে। যথাযোগ্য প্রণোদনার মাধ্যমে সেই সম্ভাবনার সর্বোচ্চকরণ করা দরকার।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘মানুষ বাঁচানো’ ও ‘অর্থনীতি বাঁচানোর’ জন্যে বেশ কিছু ব্যবস্হার কথা উল্লেখ করেছেন। এর বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সন্দেহ নেই; কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের যা করণীয়, তাই আমরা করি না কেন? আমি যে তা করছি না, তার জন্যে তিনটে বিষয় দায়ী। এক, আমি মনে করি, ‘শুধু আমি ভালো, অন্য সবাই মন্দ’। দুই, আমি ভাবি, ‘আমার দায়িত্ব শুধু সমালোচনার’। তিন, আমি এক ‘অভিযোগের সংস্কৃতিতে’ বিশ্বাসী। সন্দেহ নেই, এ মুহূর্তে আমার এ সব মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন।
শেষের কথা বলি। এ সব কিছুর প্রেক্ষাপটে ‘কিছুই হবে না’, কিছুই পারা যাবে না’, ‘কিছুই করার নেই’, এমন সব নৈরাশ্যের লেবাস ছেড়ে দেখাই যাক না ‘কিছু করা যায় কিনা’। একা একা নয়, যুথবদ্ধ ভাবে। সবাই মিলে আশাবাদী হয়ে দেখিই না – আর যাই হোক, নৈরাশ্যের তো ইতিবাচক দিক নেই।