বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত তৈরি পোশাক খাত। রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ যোগান দেয় এই শিল্প। করোনার প্রকোপে বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যয়ে তৈরি পোশাকখাতও বিপর্যস্ত। ক্রেতা দেশগুলো ব্যাপক হারে করোনা আক্রান্ত হওয়ায় ক্ষতির তালিকায় এই শিল্প উপরের দিকে আছে। আসছে বাজেটে এ খাতকে কর সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি ব্র্যান্ড,বায়ারদের থেকে দায়িত্বশীল আচরণের আশা করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) আরএমজি ইউনিটের কর্মসূচি প্রধান ও প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি আশা প্রকাশ করেন সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে করোনা বিপর্যয়ের মাঝেও টিকে যাবে তৈরি পোশাকখাত। বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে দেশের অর্থনীতি।
চাহিদা জনিত চ্যালেঞ্জ
ইআরএফ মিডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, চাহিদা এবং সরবরাহ দু’দিক থেকেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকখাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। প্রধান ক্রেতা দেশগুলো (ইউরোপ, আমেরিকা) কনোরায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। লম্বা সময় ধরে ঐ সব দেশে চলছে লকডাউন। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে। টান পড়েছে ক্ষয়ক্রমতায়, ফলে তারা যেসব পণ্য সাধারণত কিনে থাকেন তা কেনার পরিমাণ কমে যাবে। যেহেতু তাদের আয় ও কাজের নিশ্চয়তা নেই এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিও আছে তাই ঐ সব দেশের ভোক্তারা জরুরী ছাড়া অন্য যে কোন ধরনের পণ্য কেনা কমিয়ে দিবে। ঐ দেশগুলোর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার না হওয়া এই প্রবণতা থাকতে পারে। এতে চাহিদার সংকটে পড়েছে তৈরি পোশাকখাত। এর সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েই আগামীর পথচলা ঠিক করতে হবে বলে মনে করেন এই গবেষক।
সরবরাহের দিকে চ্যালেঞ্জ
সরবরাহ জনিত চ্যালেঞ্জ হিসেবে, কারখানার স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এই ঝুঁকি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), কলকারখানা অধিদপ্তর ও বিজিএমইএ নিজস্ব গাইড লাইন মেনে চলার চেষ্টা করছে। তবে অনেক স্থানে শ্রমিকদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর বলে দিচ্ছে, স্বাস্থ্য ঝুঁকি মেকাবেলায় ঘাটতি আছে। এর ফলে ব্র্যান্ড, বায়াররা কারখানার কর্ম পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। তাদের ভোক্তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় বাতিল করতে পারে ক্রয় আদেশ।
নতুন সম্ভাবনা
চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি করোনায় সম্ভাবনাও দেখছেন ড. মোয়াজ্জেম। ২০০৭-০৮ সালে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক মন্দার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ঐ সময়ে দেখা গেছে ক্রেতা দেশগুলোতে স্বল্পমূল্যের পোশাকের চাহিদা বেড়েছিল। ভোক্তাদের আয় কমে যাওয়ায় তারা খরচ বাঁচাতে কম মূল্যের দিকে ঝুঁকেছিলেন। করোনা পরবর্তীও এই ধরনের চাহিদার উড়তি ভাব থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন গোলাম মোয়াজ্জেম। তবে এই সুযোগ নির্ভর করছে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম কতটা সুবিধা নিতে পারছে। সেই সাথে সবচেয়ে বড় রপ্তানিরকারক চীনের সুবিধা নেয়ার বিষয়টাও এখানে উল্লেখযোগ্য বলে তার অভিমত। এসব দেশের সাথে প্রতিযোগিতা করেই নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।
ক্রয় আদেশ ফিরে আসা
করোনায় বাতিল কিংবা স্থগিত হওয়া ক্রয় আদেশের কিছু ফিরে আসার পিছনেও সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে বলে মনে করেন গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি জানান, করোনার কারণে এখন পর্যন্ত ৩.৫ বিলিয়ন ডলার (৩৫০ কোটি) মূল্যের আদেশ বাতিল অথবা স্থগিত হয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে এর মাঝেও ১ বিলিয়ন ডলারের (১০০ কোটি) রপ্তানি আদেশ ফিরে এসেছে। এমনকি নেদারল্যান্ড, সুইডেন জানিয়েছে তাদের কোন বায়ার যেন ক্রয় আদেশ বাতিল না করে সেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই পথে হাঁটছে জার্মানিও। এগুলো আসছে দিনের জন্য ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করবে বলে আশাবাদ এই অর্থনীতিবিদের।
মালিকদের যত সুবিধা
অবশ্য যেসব অর্ডার এখন আসছে তাতে সব শ্রমিককে কাজে লাগানোর সুযোগ নেই বলে মনে করেন মোয়াজ্জেম। এজন্য সিপিডি’র পক্ষ থেকে সুপারিশ হচ্ছে, যেন কারখানাগুলো শ্রমিকদের ন্যুনতম আয় নিরাপত্তা দেয়। তাদের ছাঁটাই না করে। সরকারের কাছ থেকে তিন মাসের ঋণ সুবিধার প্রথম মাসের টাকা মালিকরা হাতে পেয়েছেন উল্লেখ করে তাদের (মালিকদের) পাওয়া আরো কিছু সুবিধার কথা জানান গোলাম মোয়াজ্জেম। কারখানার ঋণের কিস্তি স্থগিত রাখা, ঋণের সরল সুদ বিবেচনা করা, ঋণপত্রের অর্থ পরিশোধের সময় পিছিয়ে দেয়া, রপ্তানি আয়ের অর্থ দেশে আনার সময়সীমা বাড়ানো, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিল পরিশোধের সময় বাড়ানো। এসব দৈনিক খরচের ক্ষেত্রে মালিকরা যে স্বস্তি পেয়েছেন তার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন সিপিডি’র এই গবেষক।
বাজেটে করণীয়
এসব সুযোগ সুবিধার ধারাবাতিকতা বাজায় রেখে আসছে বাজেটে আরো কিছু সুবিধা দেয়ার সুপারিশ করছেন তিনি। ড. মোয়াজ্জেম বলেন, এখন মুনাফা অর্জন করার সময় নয়। বরং কারখানাগুলোর টিকে থাকা ও ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষার সক্ষমতা অর্জন করাকেই প্রধান সফলতা হিসেবে বিবেচ্য হবে। এজন্য সরকারকে বাজেটে আরো কিছু উদ্যোগ নেয়ার কথা বলছেন তিনি। এক্ষেত্রে যেসব কারখানা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) মধ্যে পড়ে এবং সাব কন্ট্রাক্টে কাজ করে তাদের দিকে বিশেষ নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের ঋণ প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বড় বড় কারখানাগুলোকে ঋণ দিলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো বঞ্চিত হবে উল্লেখ করে মোয়াজ্জেম বলেন, যেহেতু বড়দের সক্ষমতা বেশি এবং সরকারের তহবিল সংকট আছে তাই ছোটদের বেশি সুযোগ দেয়া উচিত।
কর সুবিধা
কর সুবিধার ক্ষেত্রে করপোরেট কর কমাতে না পারলেও পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন এই তৈরি পোশাক গবেষক। তিনি বলেন, সাধারণত নভেম্বরের দিকে করপোরেট কর পরিশোধ করতে হয়। এ বছর এই সময়সীমা বাড়িয়ে মার্চ পর্যন্ত করার সুপারিশ করেছেন। সেই সাথে করের অর্থ কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেয়ার কথাও বলেছেন তিনি। অন্যদিকে অগ্রিম আয় কর, মূল্য সংযোজন করের ক্ষেত্রেও এই ধরনের সুবিধা দেয়া যায় কিনা, তা ভাবতে হবে। এছাড়া শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে যেসব কারখানা বড় ধরনের বিনিয়োগ করবে, সেই বিনিয়োগের ওপর করারোপ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে যেসব প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়বে তাদের করপোরেট কর আগের দেয়া দুই বছরের করের সাথে সমন্বয়ের সুযোগ আছে বলেও মনে করেন ড. খন্দকার মোয়াজ্জেম।
ক্রেতাদের দায়বদ্ধতা
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্য ক্রয় করা ক্রেতাদের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। যেহেতু করোনাতে সব পক্ষই আক্রান্ত তাই তাদেরকে রেসপন্সিবল বিজেনেস প্র্যাকটিস (আরবিপি) বা দায়িত্বশীল ব্যবসা অনুশীলন করতে হবে। তারা যেসব অর্ডার বাতিল করেছিল, সেগুলোর পিছনে কারখানা মালিকদের যে ব্যয় হয়েছে তার কিছু অংশ বহন করা উচিত। এছাড়া অর্ডার বাতিল করলে কিংবা ভবিষ্যতে কী পরিমাণ ও কখন অর্ডার দেয়া হবে তা আগেভাগে জানালে কারখানা মালিকদের প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হয়। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বায়াররা, শ্রমিকদের মূল বেতনের কিছু অংশ বহন করতে পারে। কিংবা অগ্রিম অর্থ পরিশোধ অথবা ঋণ আকারেরও দিতে পারে।
প্রয়োজন যৌথ উদ্যোগ
ইউরোপের বিভিন্ন ব্র্যান্ড, আইএলও, গ্লোবাল কল ফর একশন ইত্যাদি সংস্থা ও সংগঠন দায়িত্বশীল ব্যবসা অনুশীলনের উদ্যোগ নিচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য আশার সঞ্চার করছে বলে মনে করেন ড. মোয়াজ্জেম। এর বাইরে এশিয়ার তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোও বায়ারদের অনুরোধ করছে। এসব যৌথ উদ্যোগ শ্রমিকদের ন্যুনতম কর্ম ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে তিনি মনে করেন। এর বাইরে বায়াররা যেন শুধু চীনমুখী না হয় সেদিকেও দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। একক ভাবে চীনকে পোশাকের ক্রয়াদেশ না দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে সমহারে ভাগ করে দেয়ার ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড, বায়ারদের উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে মনে করেন ড. খন্দকার মোয়াজ্জেম।