পৃথিবী একটাই। এর উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে লক্ষ কোটি প্রজাতির প্রাণী। এরা কেউই একা এক জায়গায় বাঁচতে পারেনা। জীবিকার অন্বেষণে প্রতিটি প্রাণীকেই বেড় হতে হয় ঘরের বাইরে। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে প্রতিবছর পাখিরা আসে খাদ্য আর আবাসনের সন্ধানে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যায় প্রাণীর দল। তাদের ভিসা বা এলসি লাগে না। অতীতে লাগেনি মানুষেরও। পরিযায়ী পাখির মত খাদ্য, সম্পদ আর জ্ঞান আহরণের জন্য লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষ চষে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর একুল থেকে ওকুল। যেদিন পূর্ব আফ্রিকা থেকে আদিম মানুষেরা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে সেদিন থেকেই শুরু মানুষের বিশ্বায়ন। এক জাতির মানুষ আরেক জাতের সঙ্গে বাণিজ্য করছে তাও কয়েক হাজার বছর ধরে। সিল্ক রোডের বয়সইতো দুই হাজার বছরের বেশি। গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন নতুন কিছু নয়। বিশ্বায়ন মানে নয় শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য। বিশ্বায়নে রয়েছে মানুষের যাতায়ত, মূলধন আর পণ্য চলাচল; জ্বালানি তেল, ইমেইল, সংস্কৃতি, খবর, রেডিও সিগনাল, স্যাটেলাইট, তথ্য প্রবাহ, ঔষধপত্র, সন্ত্রাস, অস্ত্রের চালান, খাদ্য, কার্বণ ডাই অক্সাইড, রোগ, আরও কত কি।
বিশ্বায়নের বর্তমান অধ্যায় শুরু হয় শিল্প বিপ্লবের পর থেকে। যন্ত্রপালিত শিল্প কারখানা মানুষের পণ্য উৎপাদন শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দিলে উৎপাদিত পণ্য বিপণনের জন্য বিশ্বায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান আর বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার বিশ্বব্যাপী মুক্তবাজার অর্থনীতির ওকালতি শুরু করলে বর্তমান কালের বিশ্বায়নের গোড়াপত্তন হয়। বার্লিন দেয়াল আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে দেয়ার পর থেকে সারা দুনিয়ায় ব্যাপকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারনাগুলো। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় – সকল বিশ্বেই চালু হয়ে যায় মুক্তবাজার অর্থনীতির জয়জয়কার। চীন আর কিউবার মত কমিউনিস্ট দেশগুলোও বিশ্বায়নের এই স্রোত থেকে নিজের আলাদা রাখতে পারেনি। ধীরে হলেও যোগ দিয়েছে বিশ্বায়ন তথা মুক্তবাজার অর্থনীতির গড্ডালিকা প্রবাহে।
এ পর্যায়ে বিশ্বায়ন হয়েছে মূলত পণ্য আর মূলধন প্রবাহে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা গঠন করে তাকে দেয়া হয়েছে বিশ্বায়নের নিয়মনীতি প্রণয়নের কাজ। জাতিসঙ্ঘের মতই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উপড়েও প্রভুত্ব আরোপ করে ধনী রাষ্ট্রগুলো। বিশ্বায়ণের নীতিগুলো প্রণয়ন করা হয় তাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে। সকল পণ্যে ও সেবার উপর শূণ্য শুল্ক ও শূণ্য ভর্তুকি ধার্যের এবং সেই সঙ্গে সকল বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্য নিয়ে শুরু হলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি ধনীদের কারণেই। তারা নিজ দেশে কৃষি ভর্তুকি বজায় রাখে; পেটেন্ট আরোপ করতে চায় বীজের উপর; বিশ্বায়ন হয়নি জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, তথ্য, শিল্প-সাহিত্য, দর্শনের। সেবাখাত আর শ্রমিকের চলাচল উম্মুক্ত হলে উন্নয়শীল দেশগুলো বেশি সুবিধা পাবে বলে পর্যাপ্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা যায়নি এসব ক্ষেত্রে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে ধনী বিশ্বের সুযোগ বৃদ্ধির বিষয়গুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ হয়ে পড়ে। ১৯৯৮ সালের সিয়াটল সম্মেলন থেকে দেশে দেশে শুরু হয় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিশ্বায়ন বিরোধী প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। অনেক চেষ্টার পরেও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আর বিশ্বনাগরিকের পূর্ণ সমর্থন আদায় করতে পারেনি। তবে গ্যাটস থেকে শুরু করে যতগুলো নিয়ম-কানুন ডব্লিউটিও করেছিল তা অব্যাহত থাকে। চলে বাণিজ্যের বিশ্বায়ন।
এই পর্বের বিশ্বায়নে লাভবান হয়েছে উন্নত দেশের সম্পদশালীরা। তার কিছু ভাগ পেয়েছে গরীব দেশের উদ্যোক্তাগণও। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তৈরি হয়েছে নব্য ধনিক শ্রেণী; বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো দরিদ্র দেশ থেকে কম দামে পণ্য তৈরি করে নিয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করেছে ধনী দেশের ভোক্তার কাছে। এতে ধনী দেশের ক্রেতা তার দেশে পণ্যটি উৎপাদন হলে যে দামে তাকে কিনতে হত তার থেকে কম দামে পণ্য পেয়েছে; গরীব দেশের কিছু শ্রমিক মৃত্যুক্ষুধা থেকে রেহাই পেয়েছে। গরীব দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির অজুহাতে রাষ্ট্রীয় আইনগুলো নিজেদের অনুকূলে নিয়ে নিয়েছে উদ্যোক্তাগণ; গড়েছে সম্পদের পাহাড়। তাছাড়া বিশ্বজুড়ে কমেছে শিশু মৃত্যুর হার, দারিদ্র্য; বেড়েছে গড় আয়ু, আয় ও সম্পদ বৈষম্য।
বিশ্বায়নের সুযোগে কারখানাগুলো কমদামী শ্রমের দেশে নিয়ে যাওয়ায় এবং নতুন নতুন কারখানা সেসব দেশে তৈরি করায় কাজ হারিয়েছে ধনী দেশের শ্রমিকেরা। তার উপর কয়েকটি যুদ্ধের উদ্বাস্তু এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কারণে ইউরোপ এবং নিজ দেশে শ্রমের দাম কমানোর জন্য অভিবাসীদের গ্রহণ করে আমেরিকা আরেক দফা কমিয়েছে শ্রমিকের মজুরী। এই বিশ্বায়নের যুগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ধনী দেশের শ্রমিক শ্রেণি সবচেয়ে লাভবান হয়েছে সেসব দেশের বিলিয়নিয়র পরিবারগুলো। অর্থনৈতিক বৈষম্য চূড়ায় উঠেছে। মাত্র ২৬ জন ব্যাক্তির হাতে জমা হয়েছে ৩৮০ কোটি মানুষের সমান সম্পদ। দরিদ্র দেশ থেকে শোষণ করা হয়েছে শ্রমিকের ঘাম আর প্রাকৃতিক সম্পদ। সেই সঙ্গে ধ্বংস হয়েছে প্রকৃতি। পত্তন হয়েছে নয়া সাম্রাজ্যবাদের। বাণিজ্য সুবিধা দিয়ে দরিদ্র দেশগুলোকে কার্যত অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত করেছে ধনী ও শক্তিশালী দেশগুলো।
ধনী দেশগুলোতে ২০০৮-০৯ সালের আর্থিক সঙ্কট সৃষ্টি হলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশে-দেশে, শহরে-শহরে মানুষ প্রতিবাদী হয়, প্রতিরোধে পথে নামে। বদলে যায় ইউরোপ আর আমেরিকার রাজনৈতিক পট। বিশ্বায়ন এবং অভিবাসন বিরোধী রাজনীতির পালে হাওয়া লাগে। আমেরিকায় গড়ে ওঠে অকুপাই ওয়ালস্ট্রীট আন্দোলন। মাসাধীককাল ধরে চলে প্রতিবাদ, আন্দোলন। সারা দুনিয়ার জ্ঞানীগুণী বিবেকবান মানুষেরা সমর্থন জানায় এ আন্দোলনের প্রতি। সংহতি প্রকাশ করে একই দিনে বিশ্বের প্রধান ৮০টি শহরে পথে নামে লক্ষ লক্ষ মানুষ। পরবর্তীতে দেশে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্তিশালী হয়ে ওঠে লোকরঞ্জনবাদ (Populism)। হয় ব্রেক্সিট, রাষ্ট্র ক্ষমতায় লোকরঞ্জনবাদীরা ভাগ বসায় অনেক দেশে। আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন লোকরঞ্জনবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্বায়ন বিরোধিতা তুঙ্গে ওঠে। অনেক দেশ এবং অঞ্চলের সঙ্গে করা আমেরিকার বাণিজ্য চুক্তি সে বাতিল করে দেয়; অভিবাসন ঠেকাতে মার্কিন আইনসভা অর্থায়ন করে ট্রাম্প প্রস্তাবিত মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তুলতে। লোকরঞ্জনবাদী ট্রাম্প দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি চীনের সঙ্গে করা বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করে শুরু করে বাণিজ্য যুদ্ধ। চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পরার পর ট্রাম্প প্রথমে এটাকে “চীনা ভাইরাস” নামে অভিহিত করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে চীনের সঙ্গে তাদের চলমান বিরোধকে জাগিয়ে তোলেন। চীন-আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর, তথাকথিত বিশ্বায়নের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে; করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে তা আরও ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে উত্তাল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। অবাধ চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে সেখানেও।
করোনাভাইরাসের তাণ্ডব শুরু হওয়ার পর এপ্রিল মাসে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বায়নবাদী ফরাসী রাষ্ট্রপতি এমান্যুয়েল ম্যাক্রো স্বীকার করেছেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং ক্ষয়ে যাওয়া গণতন্ত্রের মধ্যে অনুভব করছি যে করোনাভাইরাস সৃষ্ট সঙ্কটের পূর্বেই প্রতিষ্ঠিত বিশ্বায়ন তার জীবনচক্রের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে।” “বস্তুত একালের বিশ্বায়ন অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য স্বার্থকে একীভূত করে জগতকে এগিয়ে নিতে এখন কিংবা কখনোই একমাত্র বা শ্রেষ্ঠ পথ ছিল না”, যুক্তরাজ্যের প্রস্পেক্ট ম্যাগাজিনে সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ কথা বলেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যানি রডরিক। নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট এবং নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নরিয়েল রৌবিনি করোনা পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি সম্পর্কে সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে লিখেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সম্পর্ক বিযুক্তিকরণ হবে দ্রুত গতিতে এবং বেশিরভাগ দেশ নিজেদের ব্যবসায় ও শ্রমিকদের রক্ষা করার জন্য প্রতিরক্ষামূলক নীতি গ্রহণ করবে। করোনা পরবর্তী বিশ্ব প্রযুক্তি, তথ্য-উপাত্ত, শ্রম, পণ্য, সেবা ও মূলধন চলাচলের উপর কঠোরতা আরোপের কাল হিসেবে চিহ্নিত হবে।”
করোনাকালে যুক্তরাষ্ট্র তার আধিপত্য আরও অনেকটা হারিয়েছে। থাইল্যান্ড থেকে জার্মানীর মাস্ক, পিপিই ছিনিয়ে নিয়ে, কানাডার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ করোনা রসদ সরবরাহ না করে, ভারতকে নিজের আইন লঙ্ঘন করে ম্যালেরিয়ার ঔষধ পাঠাতে বাধ্য করে আমেরিকা নিজের অবস্থানকে দূর্বল করে তুলেছে। পক্ষান্তরে নিজেদের দেশের করোনা সমস্যা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করে চীন পৃথিবীর অনেক দেশে স্বাস্থ্য সহায়তা পাঠিয়েছে। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে চীনের প্রভাব অনেকখানী বাড়বে বলে ধরে নেয়া যায়। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী রয়েছে অনেক দিন থেকে। সে সম্পর্ক জোড়দার হচ্ছে দিনকে দিন। চীন-ভারত বৈরিতার সম্পর্ক বহু পুরনো। মনমোহন সিং এর শেষ সরকারের সময় সে বৈরিতা বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছিল। সে সম্পর্ক বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফিরে আসার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তা হলে বাংলাদেশ আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক দুই ক্ষেত্রেই অত্যন্ত সুবিধা জনক অবস্থানে চলে যাবে। তা না হলেও বর্তমানের মত চীন ও ভারত দুই বৃহৎ শক্তিকে পাশাপাশি রেখে এগিয়ে চলার নীতি বজায় থাকলেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে বাংলাদেশ।
করোনার কারণে বিশ্ব বাণিজ্য থমকে দাঁড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম রয়েছে অনেক নিচে। যুক্তরাষ্ট্রে তেলের দাম নেমেছিল শূন্যেরও নিচে। আংক্টাড জানিয়েছে এ বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক বাণিজ্য সংকোচন হবে ২৭%। আইএমএফ আগেই জানিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি এ বছর সংকুচিত হবে ৩% যা ১৯৩০ এর দশকের মহামন্দার পরে সর্বনিম্ন। আইএমএফ এর এই প্রাক্কলনকে অনেকেই আশাবাদী বলে মন্তব্য করেছেন। বিশ্ব অর্থনীতির সংকোচন আগামীতে মহামন্দায় পরিণত হবার আশঙ্কাও করছেন অনেক। তাদের ধারণা, করোনা বিশ্ব অর্থনীতির যে ক্ষতি করছে তা কাটিয়ে স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে ৩ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যেতে পারে। এখনকার ধারনাগুলোর অনেক কিছুই আগামীতে বাস্তব হবে; অনেকগুলো ভুল প্রমাণিত হবে। তারপরেও এটা স্পষ্ট যে আগামী দু-চার বছর অর্থনীতি দুর্বল থাকবে এবং বিশ্বব্যাপী দ্রব্যের চাহিদা এবং মূল্য দুটোই কম থাকবে। এরকম একটা নিকট ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় রেখেই আমাদের আগামী দিনের কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিকল্পনাগুলো সাজাতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারের গতিবিধির উপর সতর্ক নজর রেখে আমাদের কিছু কাজ করার রয়েছে। করোনাকালে অনেক দেশ স্বাস্থ্য সেবায় নিজেদের দূর্বলতাগুলো বুঝতে পেরেছে। স্বাস্থ্য সেবা শক্তিশালী করতে হলে তাদের প্রয়োজন হবে ডাক্তার, নার্স এবং চিকিৎসা যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য রসদের। খাদ্য শস্য আমদানী নির্ভর অনেক দেশ কৃষিতে স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়টি এখন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। তারা নিজেরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাইবে। সেজন্য দরকার হবে কৃষিকাজে দক্ষ কৃষকের। বাংলাদেশের রয়েছে যথেষ্ট দক্ষ ডাক্তার, নার্স এবং কৃষক। এই দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারবে। কূটনৈতিক মিশনগুলো যে যে দেশে আছে সে দেশের এবং তাঁর পার্শবর্তী দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করলে এই চাহিদাগুলো দেখতে পাবে। চাহিদা সৃষ্টি হওয়া মাত্র তা যোগান দেবার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
বাংলাদেশ জ্বালানি তেল ও গ্যাস দুইই আমাদানী করে। সতর্কতার সঙ্গে আমরা বেশ কিছু কৌশলগত ক্রয় করতে পারি। পুর্ণ করে রাখতে পারি আমাদের ট্যাংকগুলো। বিস্তারিত বিবেচনায় উপযুক্ত মনে করলে নতুন নতুন ট্যাংক বানিয়ে আমাদের জ্বালানী তেলের ও এলএনজি’র মজুদ বাড়িয়ে রাখতে পারলে অনেক জ্বালানী খরচ সাশ্রয় করা যাবে। দেশে বেশিরভাগ শিল্পের কাঁচামাল আমদানী করতে হয়। ক্রমবর্ধমানশীল শিল্প খাতের যন্ত্রপাতির জন্যেও বাংলাদেশ আমদানির উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রফতানির নির্ভরশীল হয়ে আছে। এই করোনাকালে বিষয়টি আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সমাজকে এর জন্য ইতোমধ্যে অনেক দামও দিতে হয়েছে।
রফতানি বহুমুখীকরণের কথা অনেক আলোচনা হয় কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এবার এ ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। করোনাকালে প্রয়োজনের তাগিদে বাংলাদেশ ভ্যান্টিলেটরের মত আধুনিক যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা স্থাপন করছে। ইতোমধ্যে দেশে ইলেক্ট্রনিক্স উৎপাদন প্রায় বিপ্লব সৃষ্টি করে ফেলেছে। শুধু ইলেক্ট্রনিক্সই নয় অন্যান্য যন্ত্রপাতি তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল দেশেই রয়েছে। উচ্চতর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণেরা যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ পাচ্ছে না। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার এই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্প কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির দাম অনেক কমে গিয়েছে, আরও কমে যাবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কাজও অনেক এগিয়েছে। বর্তমান এবং নতুন শিল্পে বিনিয়োগের এখন উৎকৃষ্ট সময়।
শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি এবং তথ্যপ্রযুক্তির যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ এই করোনা দুর্দিনকে সুদিনে রূপান্তর করে ফেলতে পারে। চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে দক্ষতা ও যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যাক্তিদের। বিনিয়োগ সবসময় ঝুকিপূর্ণ। সতর্কতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের এবং বৈদেশিক মুদ্রার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হলে হিতেবিপরীত হতে পারে। অভিজ্ঞ এবং দক্ষ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সতর্কতার সঙ্গে যাচাইবাছাই করে বিনিয়োগের জন্য নির্ধারণ করতে হবে। প্রশাসনিক জটিলতা দূর করে অনলাইনে ব্যবসা ও শিল্প স্থাপনের অনুমতি, লাইসেন্স, ইত্যাদি পাবার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেবার জন্য বিভিন্ন রকমের কর, অর্থায়ণ এবং অন্যান্য প্রণোদনা দিতে হবে। দূর করতে হবে বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতাগুলো; দিতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাবলী। লালফিতার দৌরাত্ব ঘুঁচিয়ে ব্যাপকভাবে শিল্পায়ন করার এখনই সময়। এ কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য এখনই একটা কমিশন গঠন করলে দ্রুত ফল পাওয়া যাবে। কমিশন বিনিয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র নির্ধারন করে, নীতিমালা প্রণয়ন করে দিলে করোনাকাল কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ কাজে নেমে পড়তে পারবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং সরবরাহ সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। দেশের রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তার উপর রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেয়ার অনেক সুযোগ। তৈরি পোশাকের রফতানী এবং প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের প্রবাহ বর্তমানে কমে গেলেও এ অবস্থা বেশি দিন বজায় থাকবে না। আমাদের তৈরি পোশাক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অন্তর্ভুক্ত, বিলাস দ্রব্য নয়। ফলে ইউরোপ, আমেরিকা কিছুটা চালু হলেই আবার আমাদের বাজার ফিরতে শুরু করবে। একই ব্যাপার ঘটবে প্রবাসীদের রেমিটেন্সের ক্ষেত্রেও। নতুন সৃষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে রফতানি বাড়াতে পারলে আর শ্রমিক পাঠাতে পারলে বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার যোগান। দেশে অনেক অপ্রয়োজনীয় বিলাস পণ্যের আমদানি হয়। এসব আমদানি বন্ধ করলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। অর্থের অভাব হবার কথা নয়। দরকার স্বপ্নদর্শী যোগ্য নেতৃত্ব আর সাহসী ও সতর্ক পদক্ষেপ।
এক জাতির মানুষের যেহেতু অন্য জাতির মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ এবং আদান-প্রদান, লেনদেন, বাণিজ্য করতে হয়; শ্রম আর মূলধনের অবাধ চলাচল দরকার হয়; তথ্য, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বিনিময়ের প্রয়োজন হয়; সন্ত্রাস দমন করতে হয়; সর্বোপরি একই প্রকৃতি ভাগ করে নিতে হয় সেহেতু করোনাপরবর্তী বিশ্বে নতুন একটা সর্বজন গ্রহণযোগ্য বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা দরকার হবে। বিশ্বায়ন শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে অনেকে রব তুলেছেন। বিশ্বায়নের শেষ বলে কিছু নেই। বিশ্বায়ন শুরু হয়েছে কয়েক লক্ষ বছর আগে। প্রাণীকুল যতকাল পৃথিবীতে বসবাস করবে বিশ্বায়ন ততকাল চলতে থাকবে। এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে গিয়ে বিশ্বায়নের রূপান্তর হবে মাত্র। করোনাকাল হচ্ছে বর্তমান পর্বের বিশ্বায়নের শেষ সময়। করোনা উত্তর পৃথিবী হবে নতুন পর্বের সুচনা কাল।
আগামী দিনের পৃথিবী কতটা কল্যাণমুখী হবে তা নির্ভর করবে এখন আমরা কি করছি আর নিকট ভবিষ্যতে কি করব তার উপর। বর্তমান সভ্যতা যে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে নাই করোনাভাইরাস তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। করোনা আমাদের এও শিখেছে যে একটু যত্ন নিলেই সেরে উঠবে অসুস্থ পৃথিবী। বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ করোনা উত্তর পৃথিবীর রূপরেখা নির্মানে যে রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেরকম ভাবেই তৈরি হবে আগামী দিনের বিশ্বব্যবস্থা বা বিশ্বায়ন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের যথেষ্ট সুনাম এবং গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। দিনবদলের সন্ধিক্ষণে তাঁর কল্যাণকামী এবং দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব ভুমিকা রাখবে আগামী পৃথিবীর রূপরেখা প্রণয়নে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ প্রকৃতি ও তার সকল সন্তানের মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য সোচ্চার হলে আমরা পাব সকল প্রাণের সমান অংশিদারিত্বে বাসযোগ্য নতুন পৃথিবী।
১৫ মে ২০২০
কলাবাগান, ঢাকা।
অনেক গুলো বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় যেমন জালানি তেল সংগ্রহ ও মজুদ, নতুন উদ্যোগক্তাদের জন্য অন লাইন ব্যবস্থা সহজিকর, নুতন নুতন শিল্প কারখানা স্থাপনে সহায়তা ইত্যাদি।
কিন্তু এগুলো এনসিউর করার জন্য যৌক্তিক পন্থা প্রস্তাবনাও কাম্য। ধন্যবাদ।