আমার তিন কুড়ি সাত বছর জীবনকালে এরকম সম্মোহিত সময়ের সম্মুখীন এর আগে হয়েছি বলে মনে পড়ে না। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও না। এখন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে ভোলা মনপুরা দ্বীপের ফকিরচাঁন মাঝির মতো অতি অভাজনেরও দুশ্চিন্তা শেষ হয়েও হচ্ছে না। দেহ পিঞ্জিরায় অচিন পাখির মতো কেমনে সে আসে যায়, কবে সে যাবে, গেলে আবার আসবে কিনা, কিছুই এখনো জানা যায় নি। তার পায়ে বেড়ি পরানোর পথ-পন্থা এখনো অন্ধের হাতি দর্শনের পর্যায়ে।
এ রকম এক অভিনব অদৃশ্য শত্রুর সাথে বোঝাপড়ায় গত ২০ মার্চ থেকে আমি আর আমার স্ত্রী গৃহবন্দী। আমাদের বড় মেয়ে তার দুসন্তান ও স্বামীসহ নিউইয়র্কে সুপার ডোজড লকডাউনে, একমাত্র ছেলে জাপানেও ইমার্জেন্সির মধ্যে বাসায় বসে অফিস করছে, ছোট মেয়ে নিকেতনের বাসা থেকে ব্র্যাকের ২৪ ঘণ্টার চাকরি করছে। তাদের জন্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটানো আমাদের দুজনের গৃহবন্দিত্ব শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের মতো নয়। এটা স্বেচ্ছা নির্বাসন, কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন, জরুরি অবস্থা, গণ ছুটি, আইসোলেশন নানান নাম বা পর্যায়ে বিভক্ত। শব্দগুলো আগে এভাবে কানে আসে নি। আইইডিসিআর নামের যে একটা প্রতিষ্ঠান আছে এবং সেখানে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মনীষাবৃন্দ আছেন, এটাও জানলাম করোনার বদৌলতে।
১৯৭৪ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে আমার চাকরিজীবন শুরু হয় এবং সেই থেকেই নানান ঘাটে ঘাটে আমি চাকরি জীবনেই আছি। চলি নির্দিষ্ট রুটিন অনুসারে। নিয়মিত অফিস করা আর সামাজিক নানান কর্মকাণ্ডে ব্যতিব্যস্ত সময় কাটানোয় ঘর-সংসারে দেয়ার মতো ‘সময়’-এর ঘাটতি ছিল সর্বদা। করোনার কার্যপরিধিতে মনে হয় এটিও আছে যে, ‘সকলকে ঘাড় ধরে পরিবার বা সংসারমুখী করা’। বহুদিনের ক্রমপুঞ্জিভূত ‘ঘাটতি সময়’ এবার সুদে-আসলে উসুল করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে হয়তো ভাবেন, কীভাবে কাটবে ভয় আর করোনাকালের উদ্বিগ্ন মুহূর্তগুলো? আমি তো রীতিমতো অতি ব্যস্ততায় পার করছি করোনাকাল। আলহামদুলিল্লাহ!
রাতের দুই তৃতীয়াংশে (আল কোরআনের ৭৩ নম্বর সূরা মুজাম্মিলে বর্ণিত আল্লাহ তায়ালার নির্দেশমতো) গাত্রোত্থানের মাধ্যমে আমার নতুন দিন শুরুর অভ্যাস আগে থেকেই ছিল। করোনাকালে আরেকটু জোরদার করলাম অভ্যাসটি। করোনার কারণে মক্কায় কাবার তাওয়াফ থেমে গেছে, মনে বড় বেদনাবোধ করি। তাই তাহাজ্জুদ বিতর পাঠ শেষ করার পর গুরুজীর শিথিলায়ন মেডিটেশনে মনের বাড়িতে যাওয়ার কল্পনায় কাবার চারপাশে তাওয়াফ করি, সেখানে দোয়া পাঠ করি। এর মধ্যে ফজরের আজান হয়ে যায়। করোনার শর্ত মতো বাসাতেই নামাজ আদায় করি। এরপর নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত–মশহুর মর্তবা সম্বলিত সূরা চতুষ্টয় (ইয়াসিন, আর রাহমান, মূলক ও মুজাম্মিল)।
তারপর শুয়েই গুরুজীর শিথিলায়ন (মনের বাড়িতে পৌঁছনোর কখনো আগে কিংবা পরে) মেডিটেশন শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি। সকাল আটটায় দ্বিতীয় বার ঘুম ভাঙে। করোনা ঠেকাতে গলায় গরম পানির পরশ বুলিয়ে, ভাপ নিয়ে তৈরি হই বাসার সাথে লাগোয়া লনে ১৫ মিনিটের পায়চারি করতে–মূল উদ্দেশ্য নবীন রোদের পরশমণি প্রাণে ছোঁয়ানো ও ফুরফুরে বাতাস উপভোগ। বলাবাহুল্য, সারাদিনে ঘরের বাইরে বের হওয়ার এটিই একমাত্র বরাদ্দ। ঘরে ফিরে দরজার কাছে এসে স্যানিটাইজ করি দুহাত এবং মোবাইল ফোনকে।
১৫ মিনিটের ভ্রমণে ফোন নিতে চাই না। সে-ও আপত্তি করে বার বার স্যানিটাইজড হতে, কিন্তু মোবাইল ফোনটিকে রাখি আমি কত স্টেপ হাঁটলাম তার হিসাব রাখতে। বলে রাখা ভালো, করোনাকালে আমি ঘরের ভেতরেই হাঁটি সারাদিনে আরো বেশ কয়েকবার এবং সেই হিসাব রাখার দায়িত্ব এই মোবাইল ফোনটির। রাত ১২টার আগ পর্যন্ত সারাদিনের হিসাব সে দেখাবে। আমি গড়ে প্রতিদিন চার থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার হাঁটি। তবে সিংহভাগ ইনডোরে, আউটডোর ঐ ১৫ মিনিটে ১৫০০ স্টেপ বা প্রায় এক কিলোমিটার, এসময় বার্ন হয় ২৭ কিলোক্যালরি। লনে হাঁটার সময় মুখে থাকে মাস্ক, মাথায় হ্যাট বা টুপি এবং ফিরে এসে পরনের সব কাপড়চোপড় ধুয়ে গোসল করা হচ্ছে পরবর্তী কর্মসূচি।
এরপর সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা-২টা পর্যন্ত টেলি/ ভিডিও কনফারেন্স/ ই-মেইলের মাধ্যমে ভার্চুয়াল অফিস। একঘণ্টা পর পর উঠে পাঁচ মিনিট পায়চারি। যেদিন ভার্চুয়াল অফিস থাকে না, সেদিনসহ অন্যান্য ফাঁকা সময়ে গৃহস্থালী কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। এটাও করোনার মনে ছিল। ঘর ঝাড়ু দেয়া, মোছা থেকে শুরু করে গৃহকর্ত্রীকে সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় রান্নাঘরে সকল কাজে রয়েছে সক্রিয় অংশগ্রহণ। আর বাসায় কোনো তৃতীয় ব্যক্তি বা সাহায্যকারীও এখন নেই। বাইরে থেকে আসা অস্থায়ী পরিচারিকার প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে। তিন বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি থেকে পূর্ণ অবসরগ্রহণ করে আমার স্ত্রীও নানাবিধ শারীরিক সমস্যায় আছেন অনেকদিন ধরে। সুতরাং পেঁয়াজ-রসুনের খোসা ছাড়ানো থেকে শুরু করে সকল ভারী কাজে হাত লাগাতে হচ্ছে। করোনাকে ধন্যবাদ যে, এ সুবাদে আমার ‘অন দ্য জব’ ট্রেনিং ভালোই হচ্ছে। ঘর ঝাড়-মোছের সময় মনে হয়, বাড়িতে রুম বা বারান্দার পরিমাণ কম হলে ভালো হতো। অথচ যখন বাসা খুঁজতে যেতাম তখন চাইতাম বাসাটা বড় হলে ভালো হতো। একই সমতলে এই ভিন্ন উপলব্ধির কী ব্যবস্থাই না করেছে করোনা!
আমার স্ত্রী ফোনে মেয়েকে বলছেন ‘তোমার আব্বু ঝাড়ু দিয়ে অনেক ধুলাবালি বের করে আনতে পারেন’। আমি মনে মনে বলি, দেখতে হবে না সরকারের একজন সাবেক সচিব ও এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান স্বয়ং ঝাড়ু দিচ্ছেন–সিলেকশন গ্রেড কোয়ালিটি তো হবে! যা হোক হাতে-কলমে সব কাজ শেখা ও করার এমন অবকাশ করোনা না এলে পেতাম কি? তাই তো সেদিন ‘দৈনিক সংবাদ’-এ লিখলাম ‘হে করোনা তুমি মোরে দানিয়াছ ..,’ বাকিটা বুঝে নিতে হবে।
দুপুরে জোহরের নামাজ। বলে রাখি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার আগে পাঁচ বার ওযু করার সময়ই সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যাপারে দায়িত্বশীল হই। এখানে বিশেষভাবে উপলব্ধির ব্যাপার হলো যে, দিনে পাঁচ বার ওযু করার সময় দুই হাত আঙুল খেলান সহকারে ধোয়ার যে বিধান ইসলামে রয়েছে, সেটিই আজ করোনা প্রতিরোধে অন্যতম উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। আমাদের এক মুরুব্বি সেদিন বলছিলেন যে, তার ছেলে জানতে চেয়েছে, সবসময় দুহাত কেন ধুতে হবে? যেমন, ভাত খাওয়ার সময় একহাত ধুয়ে নিলেই তো চলে। কিন্তু দুই হাত ধোয়ার তাৎপর্য করোনা আসার আগে তিনি ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। অথচ এখন দুই হাত ধোয়ার বিষয়টির প্রতি আমাদের মনোযোগ ও সংস্কৃতি অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এই উপলব্ধি নিয়মিত নামাজ ও প্রার্থনা সম্পর্কেও।
আমি মনে করি, সালাত বা নামাজ হলো মেডিটেশনের সর্বোচ্চ স্তর। নির্দিষ্ট সময় অন্তে পাঁচ বার সৃষ্টিকর্তার সাথে মোলাকাত (মিরাজ-উল মুমিনিন), ‘দ্যুলোকে ভুলোকে সবারে ছাড়িয়া তোমারই চরণে পড়ি গো লুটাইয়া’। এসময় প্রভুর কাছে করোনার অনিষ্ট থেকে নিষ্কৃতি ও নিজের সুস্থতার প্রার্থনা, যাবতীয় বাড়াবাড়ি ও অন্যায়-অপকর্ম থেকে দূরে থাকার এবং মার্জনা চাওয়ার সুযোগ এনে দেয় নামাজ। নামাজের সকল ধাপের মধ্যে—স্রষ্টার প্রশংসা, রসুলের প্রতি দরুদ পাঠ, আত্মশুদ্ধির প্রতিজ্ঞা, মার্জনা প্রার্থনা সবই রয়েছে। সুতরাং ধ্যানমগ্ন হয়ে নামাজ আদায় বিধাতার কাছে আবেদন নিবেদনের প্রকৃষ্ট পথ। আমাদের মধ্যে এই উপলব্ধির বীজ বপন করতে পারলে করোনা সংকট সার্থক প্রতিপন্ন হবে।
বাড়ির বাইরে যেতে হয় না বলে জোহরের নামাজের পর বিশ্রামের সুযোগ হিসেবে পাওয়া তৃতীয় ঘুমের আগে শুয়ে শুয়ে বই পড়া একটি লোভনীয় কার্যক্রম। ভেবে রেখেছি করোনার বদৌলতে পাওয়া এই সময়-সুযোগে বেশ কয়েকটি বই পড়ব। ঠিক করে রেখেছিও, যেমন : বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’, তপন রায় চৌধুরীর ‘বাঙালনামা’, মোহাম্মদ তোয়াহা-র ‘স্মৃতি কথা’, বণিক বার্তার প্রকাশনা ‘বাণিজ্যের মহাজাগরণ’ আর বিদেশি ভাষায় এলেক্স ভন তুনজেলমানের ‘ইন্ডিয়ান সামার’, ‘দ্য সিক্রেট হিস্টরি অব দ্য এন্ড অব অ্যান এম্পায়ার’ এবং আর্চার কে ব্লাডের ‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’।
তৃতীয় ঘুমের পর লিখতে বসা। লেখা নেশা এবং পেশা হিসেবে আছে বলেই করোনাকাল আমার কাছে আশীর্বাদ মনে হয়েছিল। কিন্তু করোনা এখানেও বাধ সাধছে। করোনার ধূর্ততা ও তার অবিমিশ্র মতিগতির কারণে লেখায় ভালোভাবে মন দেয়া যাচ্ছে না। টাইপ করার কেউ না থাকায় হাতে লিখছি কিন্ত তা সময়মতো প্রকাশ করতে না পারায় বেদনাবোধ করছি।
সন্ধ্যার পর বরাদ্দ ৩৫ মিনিট ফোনে পুরনো বন্ধুবান্ধব, বয়োজ্যেষ্ঠ ও আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নিই, পারস্পরিক দোয়া কামনা করি। ড. সাদাত স্যার কিংবা জামিলুর রেজা চৌধুরীদের মতো আপনজনের মৃত্যুসংবাদে শিউরে উঠি। কখনো কখনো আত্মবিশ্বাস ও শক্তিতে ফাটল ধরে। তবে আবার ভালো কোনো কথা, প্রেরণামূলক বাণী শক্তি জোগায়। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের আশা জাগানিয়া পরিস্থিতি বিশ্লেষণ আর গুরুজীর প্রাণস্পর্শী ও হৃদয়গ্রাহী আলোচনা ও মেডিটেশন পেয়ে নিজের ভেতরে সাহস কাজ করে।
দিনের শেষে আবার লেখালেখি। এরপর তারাবি, রাতের খাবার, পায়চারি ইত্যাদি শেষ করে করোনা ভয় জয় করেই প্রথম ঘুম ঘুমাতে যাই যখন, রাত তখন প্রায় ১২টা।
লেখক: গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের সাবেক সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান