নভেল করোনাভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে উৎপাদন ও সামাজিক সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা, বৈষম্য ও বিভাজন। স্থানীয় গৃহস্থালি থেকে কারবার থেকে বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত। সে কারণেই নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ভুল বার্তা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে সামাজিক দূরত্বের কথা। বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বর্ণ-শ্রেণীভিত্তিক বিভাজন উসকে দেয়ার প্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলছে, এ বার্তাটি সে চিন্তা থেকেই এসেছে। জনগণ এগিয়ে এসে শারীরিক দূরত্বের কথা বলেছে। বলেছে সামাজিক সংহতির কথা। জনগণ ‘দিন আনে দিন খায়’ মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করছে; সামনের সারির কর্মীরা তাদের সাধ্যমতো সামাজিক সহমর্মিতা বজায় রাখতে চেষ্টা করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন বাংলা বর্ষকে স্বাগত জানাতে গিয়ে অনেকে বলেছেন, ‘আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে, আমাদের দেখা হোক বিজয়ীর বেশে’ আবার অনেকেই বলেছেন, ‘কেটে যাক করোনাকাল, ভেঙে যাক সংক্রমণের সকল শিকল।’ পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা মুক্তিযুদ্ধ প্রোথিত করেছে, তার অপ্রাপ্তি বারবার ডাক দিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনীতির অতিমাত্রায় আর্থিকীকরণ
বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা বা সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ছে। এটা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। কিন্তু সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে পুরো অর্থনীতি ও পুঁজির ব্যাপ্তি, উৎপাদন, বণ্টন ও বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত মানুষের সম্পর্কের যে বিয়োগ ঘটছে, তা নিয়ে আলাপ কম। অর্থনীতিতে ফিন্যান্সিয়ালাইজেশন হয়েছে। ‘মানি ইন’ ‘মানি আউট’—পুঁজির পুঞ্জীভবন ও পণ্যকরণ এখানে মুখ্য। মানুষ নয়, অর্থই মুখ্য হিসেবে সমাজের সর্বস্তরে মানদণ্ড হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ বিযুক্তির সঙ্গে দ্বিতীয় বিযুক্তির বড় রকমের সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু অর্থ ও বিনিময় এবং তার থেকে অর্থ বাড়াটাই সম্পর্কের মাপকাঠি হয়েছে, সেহেতু জনদ্রব্য বা পাবলিক গুডসে বাজেটের সামান্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গিন দশা
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কত সঙ্গিন অবস্থা, তা এখন হাড়ে হাড়ে বোঝা যাচ্ছে। যেমন বাংলাদেশে সংকটময় মুহূর্তে সেবা দেয়ার জন্য নিবিড় চিকিত্সা দেয়ার জন্য আইসিইউ বেড মাত্র ১ হাজার ১০০। প্রতি দেড় লাখ জনের জন্য মাত্র একটি আইসিইউ বেড। কিন্তু আইসিইউতে যেসব যন্ত্রপাতি থাকতে হয়, সেসব যন্ত্রপাতিসহ আইসিইউ বেড সাকল্যে ১১২টি। আইসিইউ বিশেষজ্ঞের অভাবে আইসিইউ চালান অ্যানেস্থেসিয়ার ডাক্তাররা! বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় অভিজাত শ্রেণী বিদেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকে একমাত্র পন্থা হিসেবে দেখেছে এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রতি কোনো মনোযোগ দেয়নি। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবার প্রতি অবহেলার কারণে এ দেশের প্রান্তিক জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করা হয়নি, অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সর্বজনীন করা যায়নি। স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়া হয়নি।
শিক্ষা ব্যবস্থাও নাজুক। বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য ছাড়াও গুণগত মান নিচের দিকে যাচ্ছে। যেমন ‘জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন অনুযায়ী ২০১৫ সালে তৃতীয় শ্রেণীতে বাংলা ও গণিতে গড় নম্বর ছিল যথাক্রমে ৬৫ ও ৪১। একই বিষয়ে ২০১১ সালে গড় নম্বর ছিল যথাক্রমে ৬৭ ও ৫০। অর্থাৎ চার বছরে দেখা যাচ্ছে দুই বিষয়েই গড় নম্বরের পতন ঘটেছে। দক্ষতার ঘাটতির কারণে যুব বেকারত্বের হার ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। এদের মধ্যে ‘শিক্ষিত’ বেকার বেশি। তাদের উৎপাদনশীলতাও অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। প্রায়ই বিদেশী জনশক্তি নিয়োগের প্রয়োজন হয়। দেশ থেকে টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। নিয়োগপ্রাপ্ত এসব বিদেশীর একটি বড় অংশ নথিভুক্ত না হওয়ায় তাদের থেকে প্রাপ্তব্য করের বড় অংশ সরকারি কোষাগারে জমা হয় না।
বাংলাদেশে বৈষম্য উচ্চগতিতে বাড়ছে। এখানে শ্রম থেকে প্রাপ্তি, পুঁজি থেকে প্রাপ্তির তুলনায় অনেক কম। জিনি সহগের সঠিকভাবে সমতা পরিমাপ করার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যদিও নির্ভুল একক নয়, কিন্তু বৈষম্য পরিমাপে এটি বহুল ব্যবহূত। ২০১০ সালের জিনি সহগ শূন্য দশমিক ৪৫৮ থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে শূন্য দশমিক ৪৮২ হয়েছে।
একটি ন্যায়সংগত রাষ্ট্র শুধু নাগরিক পরিষেবা ও নাগরিকদের সেবাদানের মাধ্যমেই টিকে থাকতে পারে। চলমান নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক চিন্তাধারা রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের বড় রকমের বিযুক্তি ঘটেছে। সমাজ ও বাজারকে সমার্থক হিসেবে দেখা হয়েছে। ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রিগান ও যুক্তরাজ্যে মার্গারেট থ্যাচার গ্রহণ করেন উদারীকরণ নীতি। এ নীতি কাঠামো বিশ্বব্যাপী মূল কাঠামো হয়ে ওঠে। বাণিজ্য ও পুঁজিবাজার উদারীকরণের পাশাপাশি সেবা খাতকেও বেসরকারীকরণ করা হয়। যুক্তি ছিল বাণিজ্যিকমুখী না করা হলে সেবা খাতের মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। ফলে রাষ্ট্র জনদ্রব্য তথা শিক্ষা, চিকিত্সা খাতে বরাদ্দ কমিয়ে নাগরিকের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়। এজন্যই নিজের পকেট থেকে ব্যয় দিন দিন বেড়েই চলছে। করোনা মহামারী এ বেসরকারীকরণের নেতিবাচক প্রভাবের দগদগে ঘাকে প্রকাশ্য করেছে। চিকিত্সাসেবার যে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে, তা স্বল্প সরকারি চিকিত্সা ব্যবস্থার পক্ষে সম্ভব হয়নি। শুধু মৃত্যুর হারকেই বাড়িয়ে তুলেছে। কভিড ১৯ আঙুল তুলে বাণিজ্যিকমুখী চিকিত্সা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও সরকারি সেবা খাতের প্রয়োজনীয়তাকে জানান দিচ্ছে।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতা
তৃতীয় বিযুক্তি ঘটেছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতা থেকে। প্রতিটি ভাইরাস তৈরি হয় প্রকৃতি বা প্রাণী থেকে। কিন্তু লক্ষ করা গেছে, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের বড় রকমের পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ অবশ্যই টেকসই পদ্ধতিতে প্রকৃতির সম্পদকে ব্যবহার করবে। কিন্তু তা না করে অত্যধিক লাভের আশায় প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের কারণে প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য বিনষ্ট করেছে। প্রকৃতির সঙ্গে প্রকৃতির যে ভারসাম্য, অর্থাৎ জৈব সম্পদ ও অজৈব সম্পদের ভারসাম্য থাকছে না। কারণ জৈব সম্পদ যা উৎপাদন করে, প্রাণিকুল তা ভোগ করে, আবার একটি অংশ সেটিকে পচায় বা ডিকম্পোজ করে। এ প্রক্রিয়া অজৈব সম্পদ তথা মাটি, পানি ও জলবায়ুর সঙ্গেও ভারসাম্য বজায় রেখে চালু থাকে। সেখানেও যথেষ্ট পরিমাণে অবহেলা করা হয়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। জীববৈচিত্র্যহানি ঘটছে। পৃথিবী বিপাক ফাটল বা মেটাবলিক রিফটের দিকে ধাবমান।
প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বাছবিচার
চতুর্থ বিষয়, প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কী হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগত আলোড়ন সর্বত্র বিরাজমান। এ বিপ্লব চিন্তার জগতে, পণ্য উৎপাদনে ও সেবা প্রদানে বিশাল পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। মানুষের জীবনধারা ও পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি ব্যাপকভাবে বদলে দিচ্ছে। জৈবিক, পার্থিব ও ডিজিটাল জগতের মধ্যকার পার্থক্যের দেয়ালে চিড় ধরিয়েছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। মানুষের মেধা ও অভিজ্ঞতার বিরতিহীন প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে অর্জিত হয়েছে। জনগণের তথা করদাতাদের অর্থায়নে এ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্ভবপর হয়েছে। বৃহৎ কোম্পানিগুলো মূলত সরকারি অর্থায়নে আবিষ্কৃত প্রযুক্তিগুলোকে নিজেদের করায়ত্ত করে একচেটিয়া বাজার তৈরি করছে। এতে যা ছিল সরকারি অর্থায়নে সৃষ্ট গণপণ্য, এখন তা হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য। দ্বিতীয়ত, এ বৃহৎ কোম্পানিগুলো ব্যাপক মুনাফা করছে। যেমন এ দুঃসময়েই বিশ্বের প্রযুক্তি ব্যবসায়ী একদল শীর্ষ ধনীর মোট ধনসম্পদ ৩০ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার বেড়েছে। বিলিয়নেয়ারদের সম্মিলিত ধনসম্পদের মূল্যমান বেড়ে ৩ লাখ কোটি ২৩ হাজার লাখে উন্নীত হয়েছে। ফলে গত ৩০ বছরে ১৯৯০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিলিয়নেয়ারদের মোট সম্পদের মূল্য ১ হাজার ১৩০ শতাংশ বেড়েছে। তবে ১৯৮০ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ধনীদের দেয়া করের পরিমাণ ৭৯ শতাংশ কমেছে। হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি সামান্যসংখ্যক বেতনভুক্ত কর্মচারী নিয়োগ করে। যাদেরকে ব্যবহারকারী বলা হয়, তারাই অধিকাংশ উৎপাদন করে। কিন্তু তাদেরকে মজুরি দিতে হয় না; বরং তারা ভোক্তা বা ক্রেতা হিসেবে এই বাজারে নিয়োজিত। এই একচেটিয়া কোম্পানিগুলো দুই প্রক্রিয়ায় উদ্বৃত্ত অর্জনের মাধ্যমে অত্যধিক অস্বাভাবিক মুনাফা করছে। একদিকে তারা স্বেচ্ছাব্রতী ব্যবহারকারী তথা উৎপাদনকারীদের মজুরি দিতে হচ্ছে না। অন্যদিকে তাদের কাছেই পণ্য বা সেবা বিক্রয় করে মুনাফাও পাচ্ছে। অথচ সনাতনী উৎপাদন ব্যবস্থায় বেতনভুক্ত কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন হয়। তৃতীয়ত, এই ডিজিটাল বাজারকে ভোক্তাদের জাগতিক কল্যাণের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু বহু গবেষণায় অসংখ্য তথ্য ও উপাত্ত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে ভোক্তাদের কোম্পানির তুলনায় অসম্পূর্ণ তথ্য থাকায়, অসম ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় এবং মায়াজাল ও প্রতারণার সাহায্যে মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পদ্ধতিগতভাবে শোষণ ও প্রান্তিকীকরণ করা হয়। ডিজিটাল বাজারগুলো ন্যায়ভিত্তিক হওয়ার পরিবর্তে অজ্ঞ গ্রাহকদের বোকা বানাচ্ছে। এ-জাতীয় বাজার ব্যবস্থা যদি সর্বস্তরে নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে প্রান্তিক ভোক্তাদের স্বাধীনতা ও আত্মপূর্ণতার সুযোগ দেয়ার পরিবর্তে শোষণ ও নিপীড়নের সুযোগ তৈরি করে দেবে।
কিন্তু কীভাবে প্রযুক্তি মানুষের কাজে লাগে, সেটি নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনা হয়নি। যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি বড় রকমের বিগ ডাটা হলো জাতীয় পরিচয়পত্র। অথচ লক্ষণীয় বিষয়, এ জাতীয় পরিচয়পত্র বহু ব্যবহারের মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো যায়নি। এর মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে ত্রাণ বিতরণ করা হলে কোনো অপচয় ঘটত না। প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের জীবন সহজ এবং তাদের জীবনমানের উন্নয়ন না ঘটিয়ে এর বিপরীত কার্যটি হচ্ছে। ফলে মানুষ এক ধরনের বিযুক্ত হচ্ছে। সামাজিক সম্পর্ক দৃঢ়তর হচ্ছে না এবং উৎপাদন থেকে অনেক বিযুক্ত থাকছে। এতে বি-শিল্পায়নও ঘটছে।
বিভাজনকামী রাজনীতির আধিপত্য
সবচেয়ে বড় বিযুক্তি রাষ্ট্রীয় বা রাজনীতির পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে। তা হলো, বিভাজনকামী রাজনীতি বা কর্তৃত্ববাদী সরকারের আধিপত্য। এর মাধ্যমে সমাজ, মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের চুক্তি বরখেলাপ হচ্ছে। চুক্তিটি ক্রমে দুর্বল হচ্ছে এবং সেটি অনেক ক্ষেত্রে ভেঙে পড়ছে।
করোনাকাল থেকে উত্তরণে নতুন সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি কাঠামো
এবারের মন্দা অন্য মন্দার থেকে ভিন্ন। সাধারণত চাহিদা ও জোগানে ব্যাপক ধসের ফলে মন্দা হয়। লকডাউনের ফলে বিশ্ব আজ এ মন্দায় নিপতিত হয়েছে। সরকার কর্তৃক অর্থনৈতিক কার্যাবলি বন্ধের কোনো নজির ইতিহাসে নেই। বিচক্ষণতার সঙ্গে সরকারকেই এ বিপর্যয় মোকাবেলায় নেতৃত্ব দিতে হবে। আগের প্রতিটি মন্দাই রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। সুতরাং প্রচলিত সমাধান কাজে আসবে না। এখানে লকডাউন তুলে নেয়া ও মধ্যমেয়াদি তথা তিন বছর মেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
জীবন-জীবিকা ও লকডাউন তুলে নেয়া, সর্বজনীন বেসিক ইনকাম গ্রান্ট
লকডাউন তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে যেতে হবে। জীবন ও জীবিকার সমন্বয় ঘটিয়ে, একটি অন্যটির থেকে প্রাধান্য না দিয়ে কৌশল ও গাইডলাইন তৈরি করতে হবে। জীবিকার জন্য প্রস্তুতিহীন লকডাউন তুলে নিলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবিকা দুই-ই নিশ্চিত করা যাবে না। আবার জীবন চালানোর জন্য আয়ের নিশ্চিতি না করলে দুরবস্থা ও সংকটের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রথমে দরকার অধিকাংশ মানুষের আয়ের। তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কৌশল হবে সর্বজনীন আয় সহায়তা বা বেসিক ইনকাম গ্রান্ট প্রদানের বাস্তবায়ন সবচেয়ে জরুরি। একই সঙ্গে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চিতি তথা পরীক্ষা, অনুসরণকরণ ও সংক্রমণ চিহ্নিতকরণ বা টেস্ট, ট্র্যাকিং ও ট্রেসিং। এ সক্ষমতা বহুগুণ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের জন্য অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে।
নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি অফিসে সাধারণ ছুটির মেয়াদ সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। এ নিয়ে ছয় দফায় ছুটি বাড়ছে। নভেল করোনাভাইরাসের অভিঘাত সবার ওপরে সমান পড়ছে না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে ‘দিন আনে দিন খায়’ খেটে খাওয়া মানুষ তথা বাড়ির কাজে সহায়তাকারী, রিকশাচালক, রাস্তার পাশের বিক্রেতা, পরিবহন শ্রমিক সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন। তারা পুরোপুরি দৈনিক উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। লকডাউনের কারণে মাঠে পড়ে আছে ফসল, বড় ক্ষতির মুখে কৃষক। এ মুহূর্তে তাদের নেই কোনো আয়, নেই সঞ্চয়ও। অনাহার-অর্ধাহারে কাটছে দিন। একই সঙ্গে হতদরিদ্রের বাইরের নিম্নমধ্যবিত্তও সর্বস্বান্ত হচ্ছে। তাদের কোনো সঞ্চয় যদিওবা থেকে থাকে, তা শেষের পথে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৭) অনুযায়ী, শ্রমশক্তির প্রায় ৮৫ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত রয়েছে। এদের সংখ্যা ছয় কোটির বেশি। এই অসংগঠিত খাতগুলোর প্রায় ৫ কোটি ১৭ লাখ শ্রমিক কোনো প্রকার চাকরির সুরক্ষা ছাড়াই কাজ করছেন। অনানুষ্ঠানিক কৃষি খাতে ২ কোটি ৮ লাখেরও বেশি কর্মী নিযুক্ত। শিল্প খাতে ১ কোটি ১১ লাখ ৬৮ হাজার এবং সেবা খাতে ১ কোটি ৭০ লাখ শ্রমিক আছেন। বেশির ভাগ শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত থাকার কারণে তারা শ্রম আইন অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকরা রফতানি খাতের জন্য সরকার ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার অর্থসহায়তার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
জরুরি ভিত্তিতে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ছয় মাসের জন্য প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা করে বেসিক ইনকাম গ্রান্ট বা প্রাথমিক আয় অনুদান প্রদান লকডাউন তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ। দেশের নানা শ্রেণীর পিছিয়ে পড়া মানুষেরও এখন আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় ব্যাংক হিসাব রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৫ লাখ ২০ হাজার ১৩৪। করোনা পরিস্থিতিতে এসব হিসাব হতে পারে নগদ সহায়তা প্রেরণের উত্কৃষ্ট মাধ্যম। এগুলো ব্যবহার করে সহজেই নগদ সহায়তা প্রান্তিক মানুষের কাছে সরাসরি পৌঁছে দেয়া সম্ভব। যাদের ব্যাংক হিসাব নেই, তারা জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ব্যাংক হিসাব খুলবেন। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করা যেতে পারে। তারাই জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজটি করেছেন।
নভেল করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত বিশ্বে উন্নয়ন ধরন ও রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বিশালসংখ্যক মানুষ এখন আয়-রোজগারহীন, ক্ষুধার্ত, নিরাপত্তাহীন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়সংগত একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই নীতি কাঠামোর মৌল ভিত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।