চলমান করোনা সংকটের এই দুঃসময়ে কৃষিই আমাদের বাঁচার পথ দেখাচ্ছে। এক দিকে জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া, অন্য দিকে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কৃষি খাতকে বাড়তি সমর্থন দেবার কোনো বিকল্প নেই আমাদের সামনে। পাশাপাশি যারা আগে থেকেই নিঃস্ব তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মহীন নতুন গরিব মানুষ। পুরোনো ও নতুন এই নিঃস্বজনের জন্য প্রচলিত খাদ্যসাহায্য ও নতুন করে নগদ সহায়তা দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীকে জোরদার করার প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই। আসন্ন বাজেটে নিশ্চয় এসব খাতেই সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। করোনা সংকটে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ সমস্যার ধরন বদলাচ্ছে। অনিশ্চয়তা বেড়েই চলেছে। এমন সময়ে মাথা ঠান্ডা রেখে যাদের প্রয়োজন বেশি তাদের জন্য স্বচ্ছভাবে বেশি বেশি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া খুব সহজ নয়। যদিও আমরা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় অন্য ১০টি দেশের চেয়ে ভালো করেছি তবুও বলতে দ্বিধা নেই ‘অতি ধনীরা’ই সরকারের কাছ থেকে বেশি সুবিধা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। তাই তাদের সংখ্যাও এ দেশে দ্রুত বেড়ে চলেছে। তা সত্ত্বেও, পুরো দশক ধরেই আমরা সমাজের পাটাতনের নিচের দিকের মানুষগুলোর জন্যও বেশ কিছু নীতি উদ্যোগ নিতে পেরেছি। বিশেষ করে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষি এবং অকৃষি খাতের খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বেশ কিছু অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি নিয়েছিল বলেই আমাদের দেশীয় চাহিদা কাঠামো এখনো মজবুত রয়েছে। আশার কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা মাত্রিক পুনঃঅর্থায়নসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে। বাজারে টাকা ঢালছে। কৃষকের জন্য ঋণের সুযোগ করে দিচ্ছে। এসএমইর জন্যও মুদ্রানীতি সমর্থন দিচ্ছে। এই সমর্থনের ফলে দেশের ভেতরে ভোগ ও চাহিদা দুটোই বাড়বে। রপ্তানি ও প্রবাস আয় কমার কারণে যে চাহিদার ঘাটতি কমবে তার বেশ খানিকটা এভাবে পূরণ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। ব্যাংক উপযুক্ত ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের সমর্থন না পেলে নতুন উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে উৎসাহি হবে বলে মনে হয় না।
মানতেই হবে আমাদের কৃষি খাত এখনো আশার আলো জাগিয়ে রেখেছে। মোট ধান উত্পাদনের ৬২ শতাংশ আসে বোরো থেকে। এই বোরো ধানের এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রশাসন, সমাজ ও কৃষকরা মিলে হাওর এলাকার পুরো ধান ভালোয় ভালোয় কেটে ফেলেছেন। আরো মাস খানিক ধরে চলবে মূল ভূ-খণ্ডের ধান কাটা। এ ক্ষেত্রেও কৃষি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীদল এক যোগে বোরো ধানের কর্তনযজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারবেন সেই আশা করছি। তবে ধান কাটার পর মাড়াই, বাছাই, প্রসেসিং এবং সংগ্রহ অভিযান সম্পন্ন করার দিকে সংশ্লিষ্টজনদের তীক্ষ নজর দিতে হবে। কৃষকদের শ্রমিকের মজুরি দেওয়া কঠিন হতে পারে। তাই তাদের ব্যাংক হিসেবে (১০ টাকার হিসেব ছাড়াও তাদের এখন মোবাইল ব্যাংক হিসেব আছে) তাদের প্রাপ্য ভর্তুকির কিছু টাকা পাঠিয়ে দিতে পারলে খুব ভালো হতো। এছাড়া সামনে পাট, সবজি, আউশ এবং আরেকটু বাদে আমন, গম, ভুট্টা, ডাল চাষের জন্য তাদের উপকরণ লাগবে। এসব পণ্যের ৯৫ শতাংশ বীজই ভারত ও কাছের দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বীজ আমদানি সহজ করার জন্য সীমান্ত বন্দরগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। আমদানি শুল্ক কমানোর পাশাপাশি পুরো বাণিজ্য প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে।
এছাড়া, কৃষি খাতকে চাঙ্গা রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট বাজার খেলোয়াড়দের (ফড়িয়া, পাইকার, আড়তদার, পরিবহন ব্যবস্থা, বাজার রেগুলেটর, দোকানদার ইত্যাদি) একইভাবে সংযুক্ত ও চাঙ্গা রাখা চাই। সরকার এ দিকে বেশ খানিকটা নজর রেখেছে। তবে এখনো বাজার কাঠামো তেমন শক্তিশালী করা হয় নি বলেই গ্রামে দুধ ও সবজি পানির দামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ শহরে দাম চড়া। এমন দুর্দিনে এমনটি হতেই পারে। তবে সংশ্লিষ্ট সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারলে কৃষি খাতের পুনরুত্থান খুবই সম্ভব। আর কৃষি বাঁচলে অর্থনীতিও বাঁচবে। গত অর্থবছরে আমাদের কৃষি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২.৫৩ শতাংশ। এ বছরও এমনটিই হবে আশা করছি। তবে কৃষি পণ্যের রপ্তানিতে ভাটা পাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রবাসে যারা আমাদের চিংড়ি, সবজি, মাছ ও মাংস আমদানি করেন তারাও বিপদে। তাই দেশের ভেতরের বাজারটি যেন সুশৃঙ্খল ও সর্বদা তত্পর থাকে সে দিকে আমাদের সবারই নজর রাখতে হবে। এমনই প্রেক্ষাপটে কৃষিখাতের জন্য বাড়তি বাজেট বরাদ্দসহ বুভুক্ষা এড়ানোর জন্য কিছু নীতি প্রস্তাব করতে চাই।
০১. নগদ সহায়তা কার্যক্রমের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সুফলও আমাদের বিবেচনা করতে হবে। যেমন : খাদ্য সহায়তা পরিবারগুলোর বর্তমান চাহিদা মেটাবে ঠিকই, কিন্তু প্রান্তিক কৃষকরা হাতে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলে পরবর্তী মৌসুমে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতে পারবে না। কাজেই ক্ষুদ্র কৃষকদের নগদ সহায়তা দেওয়া গেলে তা মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণেও রাখবে কার্যকর ভূমিকা।
০২. সীমিত সম্পদ সর্বোচ্চ সংখ্যক নাগরিকের জীবন ও জীবিকা রক্ষার জন্য ব্যয় করতে হলে কৃষি খাতের দিকে মনোনিবেশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এক দিকে কৃষিতে শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ নিয়োজিত রয়েছে, অন্য দিকে এ খাত করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। আসন্ন অর্থবছরে এ বরাদ্দ অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা হওয়া উচিত। সাম্প্রতিক অর্থবছরগুলোতে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ প্রতি বছরই কম-বেশি ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কৃষি খাতে সার্বিক বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দও ২০ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা করা উচিত। বাড়তি বরাদ্দ ইতিমধ্যেই কৃষি খাতের জন্য সরকার ঘোষিত প্রণোদনাগুলোর পরিসর বাড়ানোর জন্য ব্যয় করা যেতে পারে।
০৩. ইতিমধ্যেই স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের সমন্বিত সহায়তায় হাওর অঞ্চলে মাঠে থাকা বোরো মৌসুমের ফসল শতভাগ (সারা দেশে পুরোদমে) কেটে ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে বলে জানা গেছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকের হাতে নগদ সহায়তা পৌঁছানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে (আশা করা যায় আসন্ন অর্থবছরে এ জন্য বরাদ্দ আরো বাড়ানো হবে এবং কর্মসূচিটির পরিসরও আরো ব্যাপ্ত হবে)। তবে এই উদ্যোগগুলো থেকে সর্বোচ্চ সুফল পেতে আগামী মৌসুমেও যেন কৃষক যথাযথভাবে ফসল (বিশেষত আমন ধান, ভুট্টা, গম ইত্যাদি খাদ্য শস্য) ফলাতে, কাটতে এবং আশানুরূপ মূল্যে বাজারজাত করতে পারে—তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য বাজেটের বরাদ্দ কৃষককে নগদ সহায়তা দেওয়া ছাড়াও অন্য কিছু ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যয় করতে হবে।
০৪. খাদ্য শস্যসহ অন্যান্য কৃষি পণ্য (যেমন পোলট্রি, মৎস্য ইত্যাদি) বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রেও সরকাারি উদ্যোগে উত্পাদনকারীদের সঙ্গে বাজারের কার্যকর ও টেকসই সংযোগ (ইফেক্টিভ অ্যান্ড সাসটেইনেবল মার্কেট লিঙ্কেজ) স্থাপনের বিভিন্ন পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার।
০৫. করোনা পরিস্থিতির ফলে জারি হওয়া সাম্প্রতিক আংশিক লকডাউনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের কৃষি (বিশেষত ফসল কাটার প্রক্রিয়া) এখনো অনেক খানি কৃষি শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল (২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে ১ শতাংশের মতো ফসল মেকানিক্যাল হারভেস্টার দিয়ে কাটা হয়)। ভবিষ্যতে অনুরূপ দুর্যোগ কার্যকরভাবে মোকাবিলার জন্য কৃষির যান্ত্রিকীকরণ একান্ত জরুরি। আগামী অর্থবছরে এর ব্যাপ্তি আরো বহুগুণে বাড়াতে হবে (এ জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকা দরকার, বর্তমানের ২০০ কোটি টাকা যথেষ্ট নয়)। আসন্ন বাজেটে বিভিন্ন অ্যাগ্রোইকোলজিক্যাল জোনের জন্য এ লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া যেতে পারে।
০৬. করোনা দুর্যোগ ও তার পরবর্তী সময়ের সম্ভাব্য বাস্তবতা বিবেচনায় স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের পরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের দাবি রাখে দেশের সামাজিক নিরাপত্তা খাত। আসন্ন বাজেটে তাই এ খাতে বরাদ্দ দ্বিগুণ করার দরকার মনে হচ্ছে। পাশাপাশি বরাদ্দের এ অনুপাত অন্তত আগামী তিন থেকে পাঁচটি অর্থবছরে ধরে রাখতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির এবং সর্বস্তরের মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর করোনা মহামারির প্রভাব বিবেচনা করেই এমন প্রস্তাব করা হচ্ছে।
উপরে বর্ণিত এসব সহায়তামূলক নীতি উদ্যোগ নিতে পারলে নিশ্চয় আমরা আপৎকালীন, স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি টেকসই সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বেশ খানিকটা সফলতা অর্জন করতে পারব।