bangladesh-economy

আবদুল লতিফ মন্ডল :

২৯ এপ্রিল প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের মোট ৩৩০ কোটি শ্রমিকের অর্ধেক জীবিকা হারানোর তাৎক্ষণিক ঝুঁকিতে রয়েছে।

বলা হয়েছে, এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে যুক্ত ১৬০ কোটি শ্রমিক। এদের শ্রমের সুরক্ষা নেই, ভালো চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সুযোগ নেই, এমনকি বাড়িতে থেকেও কাজের সুযোগ নেই।

এখনই যদি তাদের সাহায্য না করা হয়, তাহলে তাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। কোভিড-১৯-এর কারণে বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের দেশের ভেতরেও প্রবাসী শ্রমিকদের চাকরি হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ দুঃসময়ে কর্মসংস্থান ধরে রাখতে তাদের কীভাবে সাহায্য করা যেতে পারে, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুযায়ী দেশে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। তবে সপ্তাহে যারা ১ ঘণ্টা কাজ করছেন তাদের বেকার হিসেবে গণ্য না করে বেকারত্ব নির্ধারণে আইএলও’র সংজ্ঞার সঙ্গে একমত নন দেশের বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, আইএলও’র সংজ্ঞা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তারা মনে করেন, কর্মক্ষম তবে শ্রমশক্তির বাইরে চার কোটির বেশি মানুষ প্রকৃত বেকার।

সুতরাং দেশে বেকারত্বের হার ২০১৬-১৭ বিবিএসের রিপোর্টে নির্ধারিত হারের চেয়ে অনেক বেশি। আর দেশের শ্রমশক্তির চূড়ামণি যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। ১৫ থেকে ২৯ বয়সের যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের গড় হার ১১ দশমিক ১ শতাংশ। আবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাস যুবকদের তুলনায় উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা সম্পন্নকারী যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার অনেক বেশি।

বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা সম্পন্নকারী শিক্ষিত যুব বেকারদের হার যথাক্রমে ২ দশমিক ৭, ৪ দশমিক ৬, ১৪ দশমিক ৯ এবং ১১ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা সম্পন্নকারী শিক্ষিত যুবকদের বেকারত্বের হার জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হারের তিনগুণ বা তার বেশি।

দেশে যখন বেকারত্বের হারে এই উল্লম্ফন, তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো করোনাভাইরাসের আঘাত। শারীরিক তথা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে করোনা বিস্তার রোধে গত দেড় মাস হল কৃষি খাত বাদে অন্যসব খাতে উৎপাদন প্রায় বন্ধ।

জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি অবদান (৫৫ শতাংশ) রাখা সেবা খাত বন্ধ। যাত্রীবাহী বিমান, ট্রেন, বাস ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ। কাঁচাবাজার, ওষুধ, সুপার শপ ও নিত্যপণ্যের দোকান ছাড়া সব ধরনের দোকান-মার্কেট বন্ধ। অধিকাংশ অফিস বন্ধ। বন্ধ সব ধরনের আদালত। বন্ধ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

এসবের বিরূপ প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির ওপর। বৈশ্বিক করোনাভাইরাসের কারণে অস্বাভাবিক পতন ঘটেছে দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের রফতানি আয়ে।

তৈরি পোশাকের প্রধান আমদানিকারক ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ক্রয়াদেশ বন্ধ করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র তথ্য মোতাবেক, চলতি বছরের এপ্রিলেই গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ আয় রফতানি কমেছে।

পোশাকের পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোয় চামড়া, হিমায়িত মাছ, প্লাস্টিক পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং শাকসবজি রফতানি বন্ধ হওয়ার পথে।

এসব খাত থেকে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। কেবল হিমায়িত খাদ্য রফতানি থেকে দেশ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছিল (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৯)।

অন্যদিকে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের মার্চ মাসের এক প্রতিবেদনে বৈশ্বিক করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নোভেল করোনাভাইরাসের কারণে চীনের মধ্যবর্তী পণ্য রফতানি দুই শতাংশ কমলে যেসব দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাংলাদেশ তার একটি।

করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের চামড়াশিল্প, বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্প, কাঠ ও আসবাব শিল্পের ক্ষতির আশঙ্কা করছে আঙ্কটাড। প্রতিবেদন অনুযায়ী চীনের অর্থনীতি শ্লথ হওয়ায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে চামড়াশিল্পে। এ শিল্পে ১৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে বস্ত্র ও আসবাবপত্র শিল্পে এক মিলিয়ন ডলার করে ক্ষতি হতে পারে। এদিকে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের শিল্প ও বাণিজ্যের ১৪টি খাত করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে- তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পোশাক খাতের অ্যাক্সেসরিজ, প্রসাধন, বৈদ্যুতিক পণ্য, পাট, সুতা, মুদ্রণ শিল্প, চিকিৎসা সরঞ্জাম, চশমা, কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিক পণ্য, কাঁকড়া ও কুঁচে এবং প্লাস্টিক শিল্প।

অর্থনীতির ওপর এসব চাপের প্রভাবে শ্রমিকের, বিশেষ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে পড়ার মুখে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সূত্রের বরাত দিয়ে ১ মে যুগান্তরের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে কেবল পরিবহন খাতের ৫০ লাখ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন লকডাউন থাকায় এত বিপুলসংখ্যক পরিবহন শ্রমিকের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে। রেস্তোরাঁ, পর্যটনসহ সেবা খাতের শ্রমিকদের চাকরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

শুধু দেশেই নয়, বৈশ্বিক করোনার কারণে কাজ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের অর্থনীতির অন্যতম বৃহৎ শক্তি প্রবাসীরা। প্রবাসে থাকা প্রায় ১ কোটি শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য অংশই বেকার হয়ে পড়বে বলে মনে করছে বিভিন্ন মহল।

সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের বরাত দিয়ে মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারীতে অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং তেলের দাম কমে যাওয়ার কারণে শুধু সৌদি আরব থেকেই বিতাড়িত হবেন প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক। মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে আরও জানা যায়, সৌদি আরব ছাড়াও কাতার, ইরাক, বাহরাইনসহ উপসাগরীয় দেশগুলো অবৈধ শ্রমিকদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য প্রতিনিয়ত চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে। এরই মধ্যে কয়েকটি দেশ থেকে অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

উপরের বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট, বৈশ্বিক কোভিড-১৯-এর কারণে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ধরে রাখা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সরকারকে একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ দেখতে হবে। অভ্যন্তরীণ দিক থেকে বিভিন্ন কলকারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে, অনেক কারখানা মালিক লে-অফ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছেন। ফলে বহু শ্রমিক কাজ হারাবে, যা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

জানা যায়, করোনা মোকাবেলায় এ পর্যন্ত ১ লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার, যার বেশির ভাগ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ঋণ আকারে দেয়া হবে। শ্রমিকদের পক্ষ থেকেও প্রণোদনার দাবি এসেছে। বলতে গেলে দেশের সব খাতই প্রণোদনা চায়। কিন্তু সরকারের পক্ষে ঢালাওভাবে সব খাতে প্রণোদনা দেয়া সম্ভব নয়। তাই সরকারের পাশাপাশি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কলকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের এগিয়ে আসতে হবে শ্রমিক স্বার্থরক্ষার্থে। সরকার ও মালিকপক্ষ মিলেই ঠিক করতে হবে কীভাবে শ্রমিকদের এবং শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে রাখা যায়।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবস্থান অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, প্রায় ৪০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিকের বাস মধ্যপ্রাচ্যে।

এর মধ্যে অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা কমবেশি ২৫ শতাংশ। শুধু অবৈধ শ্রমিকের ওপর আঘাত আসেনি, আঘাত আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বৈধ শ্রমিকদের ওপরও। বিজ্ঞজনরা বলছেন, প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ষায় সরকারকে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে জোর আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।

যারা চাকরি হারিয়েছেন, তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা এবং সেখানে বৈধভাবে বসবাসকারীদের ফেরত না পাঠানোর জন্য লবিং জোরদার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, রেমিটেন্স প্রবাহের মূল উৎস মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। সেখান থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক দেশে ফেরত এলে রেমিটেন্স প্রবাহে মারাÍক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা আমাদের অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করে ফেলতে পারে।

সবশেষে বলতে চাই, দেশে ও প্রবাসে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ধরে রাখার সব ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা প্রবাস থেকে ফিরবেন, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আইএলও’র ডাইরেক্টর জেনারেলের বক্তব্যটিও আমাদের স্মরণে রেখে তা অনুসরণে চেষ্টা করতে হবে। তিনি বলেছেন, কোভিড-১৯ শুধু একটি স্বাস্থ্যগত সংকট নয়, এটা একটি শ্রমবাজার ও অর্থনৈতিক সংকট, জনগণের ওপর যার গভীর প্রভাব পড়েছে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

[email protected]

ক্রেডিট: যুগান্তর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *