corona-cercle

সৈয়দ রাইয়ান আমীর:

র‍্যাগ্নার নার্ক্সির দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের সঙ্গে কম বেশি সবাই পরিচিত। দরিদ্র দেশসমূহের মূলধন তৈরির প্রতিবন্ধকতা আর দরিদ্রতা থেকে বেরিয়ে আসার অপারগতা বিষয়ক তার কাজ বৈশ্বিকভাবে বেশ সমাদৃত। কীভাবে অল্প আয়ের দেশগুলো মূলধন বা সম্পদ তৈরি করতে না পেরে পিছিয়ে পড়ার এক চক্রের মাঝে আটকে থাকে তার প্রামাণ্য বিশ্লেষণ পাওয়া যায় তার “Problems of Capital Formation in Underdeveloped Countries” (১৯৫৩ সালে প্রকাশিত বই যা মূলত তার বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তব্যের সংকলন), “Growth in Underdeveloped Countries: Some International Aspects of the Problem of Economic Development.”(১৯৫২) সহ অন্যান্য রচনাসমূহে। আমার মূল বক্তব্যের সঙ্গে এই তত্ত্বের সামঞ্জস্যতা আলোচনার পূর্বে প্রথমে দুটি সমস্যার কথা উল্লেখপূর্বক বৈশ্বিক অবস্থার কিছু তথ্য দেখে নেয়া যাক।

বর্তমান করোনা সঙ্কট চলাকালীন প্রকটভাবে যে সমস্যাটি দেখা দিয়েছে তা হল লকডাউন নিশ্চিতকরণ। বিভিন্ন সামাজিক ও বিশেষ করে অর্থনৈতিক কারণে মানুষ নিত্যদিন ঘর থেকে বের হচ্ছে আর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে করোনা সংক্রমণের। যারা একেবারে প্রান্তিক জনগণ এই লকডাউন তাদের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে আয়ের পথ যা তাদেরকে ঘর থেকে বের হতে এক প্রকার বাধ্য করছে। সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন সাহায্যের ব্যবস্থা থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে তা বেশ অপ্রতুল ও অব্যবস্থাপনার শিকার। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা আসায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতি। দিনমজুর, ভাঙ্গারি [প্লাস্টিক] শ্রমিক, রেস্তোরাঁ শ্রমিক, গৃহকর্মী, পরিবহন শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ ও কারখানার শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দোকান সহকারী ও রিকশা চালকসহ মোট জনসংখ্যার মোট ৬৩ শতাংশ অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে এই করোনা সংকটে- এমনটাই দাবি ব্র্যাক ও দ্য পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার পরিচালিত এক গবেষণা নথির।

রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার ৩০০টি বস্তি আছে যাতে মানুষ থাকেন ৬ লাখ ৪৬ হাজার জন, যাদের বেশিরভাগ দরিদ্র শ্রমিক ও রিকশাচালক। সরকারী তথ্য অনুসারে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

এডিবি অনুমান করছে যে যদি এই করোনা পরিস্থিতি ৬ মাস স্থায়ী হয় তবে বাংলাদেশ তার জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ১ শতাংশ হারাবে। এর ফলে বাংলাদেশ হারাতে পারে প্রায় ৩ দশমিক ০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উপরন্তু এ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ৮ লাখ ৯৪ হাজার ৯৩০ চাকরি হারানোর আশংকা তো রয়েছেই।

এই অর্থনীতির ধাক্কা যে শুধু বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাচ্ছে তা না। প্রাথমিক অনুমানে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলন (ইউএনটিএটিএডিডি) বৈশ্বিক আয়ে ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঘাটতির আশংকা করছে। এটি বৈশ্বিক বার্ষিক প্রবৃদ্ধিকে আড়াই শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে পারে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) আশংকা করছে যে কভিড -১৯ এর কারণে বিশ্ব তার জিডিপির দশমিক ০৮৯ শতাংশ থেকে দশমিক ৪০৪ শতাংশে হারাতে পারে। আর্থিক হিসাবে যা ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৩৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে। এর দুই-তৃতীয়াংশের প্রভাব শুধু চীনের ওপর পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি, তাদের বাণিজ্য বিভাগের সূত্রমতে, বছরের প্রথম প্রান্তিকে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হারে কমেছে। এটি ২০১৪ সালের পর প্রথম হ্রাস এবং ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে নেতিবাচক ত্রৈমাসিক পতন, যা কিনা দেশটির গভীর অর্থনৈতিক মন্দায় প্রতিফলন ছিল।

বিবিসির মতে মার্কিন খাদ্য পরিষেবা এবং আবাসন ব্যয় ৭০ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে পোশাক এবং এ সংক্রান্ত ক্রয় ৪০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। ২৮ এপ্রিল, জেনারেল ইলেকট্রিক জানায় যে তাদের প্রথম ত্রৈমাসিকে রাজস্ব আয় 8 শতাংশ কমেছে, অন্যদিকে বোয়িং ৪৮ শতাংশ রাজস্ব হ্রাসের কথা জানিয়েছে এবং বলেছে যে এটি সেবা হ্রাস ও চাকরি কমানোর পরিকল্পনা করেছে। ফলে সার্বিক ভাবে বেকারত্ত সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।

মার্চের মাঝামাঝি থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৬ মিলিয়নেরও বেশি লোক বেকারত্বের শিকার হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, জুন থেকে তিন মাসের মধ্যে ৩০ শতাংশ বা তারও বেশি অর্থনৈতিক সংকোচনের সম্ভাবনা রয়েছে।

অনেক পরিবারকে সরাসরি অনুদানের আয়তায় আনা সহ অন্যান্য খাতে প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যায়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করছে তারা। ফেডারেল রিজার্ভও সুদের হারকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে দেওয়ার সহ অনেক জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছে।

ব্লুমবার্গের মতে, জার্মান অর্থনীতিতে হ্রাস ঘটতে পারে ২ শতাংশ যা শুধু বছরের প্রথম অংশের জন্য প্রযোজ্য কেননা আরও নেতিবাচক পরিস্থিতির আশংকা করছে তারা। আইএনএসইই পরিসংখ্যান সংস্থার মতে, ফ্রান্সের জিডিপি প্রথম ত্রৈমাসিকে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা ১৯৪৯ সালের পর থেকে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক পতন। একই সময়ে ইতালির হ্রাসের পরিমাণ ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অপরদিকে স্পেন হারিয়েছে এর জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ।

আমাদের দেশেও নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যকেজ আমাদের মত অর্থনীতির জন্য বেশ বড় অংকের হিসাব বলেই তা বাস্তবায়নে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংক খাত। সবমিলিয়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার এ প্রণোদনা প্যকেজ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবথেকে বড় প্যকেজ।

শুরুতেই র‍্যাগ্নার নার্ক্সির দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের উল্লেখের মাধ্যমে যে বিষয়টিতে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করা হয়েছে তা হল এই লকডাউন তুলে দিলে একদিকে রোগের প্রকপ বাড়বে অসহনীয় হারে, অপর দিকে লকডাউন সচল রাখলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য যোগান দেয়া হবে আরেক বিরাট পরীক্ষা সমতুল্য; দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মত এ যেন করোনার দুষ্টচক্র। যেখানে এক দিকে অসুখের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে লকডাউন অপর দিকে তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না হবার আশংকা।

এত এত অর্থ ব্যয়ে এত বড় সব প্রকল্প নেয়ার মাধ্যমেও বৈশ্বিক উত্তর (Global North) আদতে অর্থনৈতিক ধস ঠেকাতে সক্ষম হবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয়, সেখানে বাংলাদেশের মত অর্থনীতির দেশসমূহ বেশ চাপে পড়বে তা বলাই বাহুল্য। তাই গোটা বিশ্ব কোন অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে এগিয়ে চলেছে তা মনে হয় এক বিপুল গবেষণার বিষয় হতে পারে। যেখানে আমাদের প্রথম চিন্তা করতে হবে লকডাউন রেখে ( লকডাউন পুরোপুরি তুলে নিলে কী হবে তা আঁচ করার জন্য ইতালি, স্পেন বা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে নজর দেয়াই যথেষ্ট) কীভাবে প্রান্তিক জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা পায়।

“আমাদের অর্থনীতি ইউরোপীয় বা পাশ্চাত্য দেশগুলোর মতো শক্তিশালী নয় এবং একটি কার্যকর অর্থনীতি না নিশ্চিত করে আমরা এত বিশাল সংখ্যক মানুষকে ত্রাণ দিতে পারব না”, বলেন আবু আহমেদ, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাবে কর্মরত আছেন। তুরস্কভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আনাদোলু এজেন্সিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন যে, যদি বিদ্যমান পূর্ণ লকডাউন আরও দীর্ঘায়িত হয় তবে এটি দেশের খাদ্য মজুদকে নড়বড়ে করে দেবে। সুতরাং, সরকারের উচিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য সম্পূর্ণ প্রচেষ্টা চালু রাখা এবং লকডাউনটি আংশিকভাবে তুলে নেয়া যাতে দরিদ্র মানুষেরা জীবিকানির্বাহ করতে পারে।

একই সঙ্গে খাদ্যসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত ও করোনার প্রকোপ ঠেকানো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হবে সরকারের জন্য। তবে এই আংশিক লকডাউন উত্তোলন আমাদের মত অবকাঠামোতে কতটা কার্যকরী হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার।

লেখক: সৈয়দ রাইয়ান আমীর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *