নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। বাজেট থেকে শুরু করে প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নেও এটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। করোনা মোকাবেলাকেই প্রতিটি দেশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সাজাচ্ছে তাদের পরিকল্পনা। বাংলাদেশকেও একই পথে হাঁটতে হবে। এরই মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণাসহ ব্যয়সংকোচনের পথে হাঁটছে সরকার। বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় রাজস্ব খাতে। উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের একটি অংশ আবার প্রতি বছর অব্যয়িত থেকে যায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলে সংশোধিত এডিপির মধ্যে ব্যয় করতে পেরেছে ৯০ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। ব্যয় করা যায়নি বরাদ্দের বাকি ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার বিবেচনায় নয় মাসে মোট বরাদ্দের ৪৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। চলমান পরিস্থিতিতে অর্থবছরের বাকি তিন মাসে এ অর্থের কতটুকু ব্যয় করা যাবে, সে বিষয় নিয়ে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের সংশয়। কারণ চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে গত মাসে পুরোপুরি থমকে ছিল অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন। এ অবস্থা বিরাজ করতে পারে চলতি মাসেও। ফলে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে জুন শেষেও প্রকল্প বাস্তবায়নে খুব বেশি গতি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এডিপি সম্পূর্ণভাবেই পুনর্বিন্যাস করার কথা বলছে। অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগে এখনকার প্রেক্ষাপটে অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ রয়েছে। সেজন্য অগ্রাধিকার খাতগুলোকে চিহ্নিত করে এখনই অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। তেমনি অপ্রয়োজনীয় ও অর্থনীতির জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলো থেকে প্রকল্প বাদ দিতে কিংবা স্থগিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে এমআরটি, পদ্মা সেতু কিংবা কর্ণফুলী টানেলের মতো প্রকল্প চলমান রেখে বাকি কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো স্থগিত রাখতে পারে সরকার। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা কার্যক্রমে অর্থায়নের ক্ষেত্রেও যাতে অর্থ সংকট তৈরি না হয়, সেজন্যও এডিপি পুনর্গঠন প্রয়োজন।
এডিপি বাস্তবায়নে অবিলম্বে চারটি খাতে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। খাত চারটি হলো স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, খাদ্য ও কৃষি এবং শিল্প ও বাণিজ্য। করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে চলতি ও বিনিয়োগ ব্যয় বাড়াতে হবে। এর পরই গুরুত্ব দিতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। সেখানে কর্মহীন ও প্রান্তিক মানুষদের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অর্থ ও খাদ্যসহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি গোটা বিশ্বেই খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই কৃষি ও খাদ্য খাতে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকল্প নিয়ে আসতে হবে। এ দুটি ক্ষেত্রে সক্ষমতা গড়ে তুলতে না পারলে চলমান করোনা পরিস্থিতি আরো বড় বিপদ নিয়ে আসতে পারে। এর পরই শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্য খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। সেখানে দেশী শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোকে সুরক্ষা দিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদেশী সহায়তা পাওয়াটাও আগামী অর্থবছর কঠিন হয়ে পড়বে। যারা বা যেসব দেশ আমাদের সহায়তা দিয়ে থাকে, তারা নিজেরাই আমাদের চেয়ে বেশি আক্রান্ত। ফলে এখন বিদেশী অর্থসহায়তা পাওয়াটাও বেশ কঠিন হবে। এখন এডিপি বাস্তবায়ন করতে হবে সম্পদের খুব স্বচ্ছ পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে। অহেতুক কোথাও প্রকল্প নিয়ে খরচ করাটা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। এডিপিতে প্রকল্প প্রেরণের ক্ষেত্রে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও কাঙ্ক্ষিত সুফল প্রাপ্তি বিবেচনায় নতুন প্রকল্পের চেয়ে চলমান প্রকল্প যথাসময়ে সমাপ্ত করার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আগামী তিন বছর এডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ ছাড়া প্রকল্প নেয়া ঠিক হবে না। রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া প্রকল্প আগামী এডিপি থেকে বাদ দেয়া এখন জরুরি। করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের রাজস্ব আয় কমবে; বরং যাদের কাছ থেকে শুল্ক-কর আদায় করার কথা, উল্টো তাদের এখন ছাড় দিতে হচ্ছে। রেমিট্যান্সে এরই মধ্যে নেতিবাচক ধারা শুরু হয়েছে। রফতানি আয়েও নেতিবাচক ধারা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় সব খাত। এজন্য রফতানি খাতের পাশাপাশি দাবি উঠেছে কৃষি, আইসিটিসহ প্রায় সব খাতেই প্রণোদনা দেয়ার। রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশাচালক, ফুটপাতের হকার, নির্মাণ শ্রমিকসহ শ্রমজীবী মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, দুগ্ধ শিল্প, পোলট্রি শিল্প, পর্যটন খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। ৭৩ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী বা সোস্যাল সেফটি নেটের দাবি, যার মাধ্যমে দরিদ্র ও অসহায়দের সহায়তা করা হবে। এসব খাতের জন্য এখন এই বিপুল অংকের অর্থ কোত্থেকে আসবে, এটিই বড় চ্যালেঞ্জ। তাই এ মূহূর্তে অপচয় বা অপব্যয় রোধ করাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পে বেশি বরাদ্দ রেখে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ কমানো যেতে পারে। একনেকের বৈঠকগুলোয় অনুমোদিত সব প্রকল্পই অগ্রাধিকারভিত্তিক নয়। অনেক প্রকল্প থাকে অগ্রাধিকারবর্জিত ও কম গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ কমাতে হবে। এমনকি এ ধরনের প্রকল্প আপাতত না নেয়াই ভালো। এডিপিতে বরাদ্দ অন্য খাতে কমিয়ে সেই অর্থ করোনা খাতে দেয়া প্রয়োজন। এডিপির বেশির ভাগ প্রকল্পের অর্থ ছাড় স্থগিত করে হলেও করোনা খাতে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। বর্তমানে অর্থ ব্যয় করে হলেও টেস্টিং, আইসোলেশন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পরে নেয়ার কথা ভাবতে হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বন্ধও করা যাবে না। এতে কর্মসংস্থান থাকবে না। কর্মসংস্থান এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক মানুষ এখন কর্মহীন। আবার অনেকে করোনা-পরবর্তীতে কাজ সংকটে পড়বে।
করোনা মোকাবেলা ও অর্থনীতি চাঙ্গা করতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। বাংলাদেশের বেসরকারি খাত এক্ষেত্রে খুব একটা এগিয়ে আসছে না। তাই সরকারকে এটি মোকাবেলায় আরো শক্তিমত্তা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এজন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন, যা আসতে পারে সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস থেকেই। আগামীতে সরকারি আয় আরো কমে আসবে। ফলে স্বল্প সম্পদ দিয়েই বাংলাদেশকে করোনা মোকাবেলা করতে হবে। এক্ষেত্রে এডিপির অব্যয়িত অর্থ ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। অর্থবছরের অবশিষ্ট তিন মাসে তাড়াহুড়া করে ৫৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় না করে তা করোনা মোকাবেলায় ব্যয় করা হোক। এক্ষেত্রে পরীক্ষার সুবিধা সম্প্রসারণ, পর্যাপ্ত হাসপাতাল ও উপকরণের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকার একের পর এক প্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে এবং সংক্রমণের সংখ্যাও বাড়ছে। এদের চিকিৎসার জন্যও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, দক্ষ জনবল ও চিকিৎসকের প্রয়োজন হবে। এটি পূরণে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় আরো বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা কার্যক্রম জোরদার এবং প্রণোদনার জন্যও বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে। সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়সংকোচনের মাধ্যমে এ অর্থ জোগাড় করা কঠিন নয়।
ক্রেডিট: বণিক বার্তা।