মৌল ভিত্তি ও স্বনামখ্যাত দেশীয় কোম্পানিকে শেয়ারবাজারমুখী করতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। শিগগির স্টক এক্সচেঞ্জটি দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা করছে। ডিএসইর ব্যবসা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ বিভাগ এ কাজ করবে।
যৌথ মূলধনি কোম্পানিগুলোর নিবন্ধন সংস্থা আরজেএসসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় এক হাজার ৮০০ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রাইভেট ও পাবলিক লিমিটেড হিসেবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম রয়েছে এমন কোম্পানির সংখ্যা ৫৫ হাজারের বেশি। এর মধ্যে মাত্র ২৯০টি দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির তুলনায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম_ এমন তথ্য জানিয়ে ডিএসইর কর্মকর্তারা বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পায়নের পথে যেতে হবে। এ জন্য যে বিপুল অর্থের জোগান নিশ্চিত করা প্রয়োজন, তা বর্তমান ব্যাংকনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। সে জন্য উন্নত বিশ্বের মতো শেয়ারবাজারকে পুঁজি উত্তোলনের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, কেবল শেয়ার বিক্রি করে মূলধন বাড়ানো নয়, স্বল্পমেয়াদি অর্থায়নে বন্ড বা ডিবেঞ্চার ইস্যুর মাধ্যমেও অর্থ সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে। দেশের শেয়ারবাজারে এ ব্যবস্থাও জনপ্রিয় করতে হবে বলে উল্লেখ করেন তারা। ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) স্বপন কুমার বালা বলেন, শেয়ারবাজারকে প্রকৃত অর্থেই পুঁজি উত্তোলনের প্রধান উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে ডিএসই। শেয়ারবাজারের বাইরে রয়েছে এমন শীর্ষ ব্যবসায়িক গ্রুপ ও শিল্প উদ্যোক্তা এবং তাদের ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর সঙ্গে শিগগির ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করা হবে। তিনি জানান, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বৃহৎ আকারে সেমিনার বা সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। তার আগে শেয়ারবাজার থেকে মূলধন উত্তোলনের সুবিধা ও প্রক্রিয়া নিয়ে ‘আইপিও বুকলেট’ নামে একটি বই প্রকাশ করা হবে। এটি উদ্যোক্তাদের শেয়ারবাজার বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা দূর করবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, সরকার শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করহারে ১০ শতাংশ রেয়াত দিয়ে থাকে। যে কোনো কোম্পানির জন্য এটা একটা বড় পাওয়া। তার পরও কোম্পানিগুলোর শেয়ারবাজারমুখী না হওয়াটা রহস্যজনক। প্রকৃতপক্ষে কোম্পানিগুলো আর্থিক প্রতিবেদনে কম মুনাফা দেখিয়ে যে পরিমাণ কর ফাঁকি দিতে পারে, তার তুলনায় ওই ১০ শতাংশ কর রেয়াত নিতান্তই সামান্য। এ কারণে কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসতে চায় না বলে তার অভিমত।
আবু আহমেদ আরও বলেন, সরকার ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট (এফআরসি) করতে যাচ্ছে। এর অধীনে একটি কাউন্সিল গঠিত হবে। ওই কাউন্সিল যদি আর্থিক প্রতিবেদন তৈরিতে দুর্নীতি দূর করতে সক্ষম হয়, তবে অনেক কোম্পানিই শেয়ারবাজারমুখী হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো উদ্যোগ সফল হবে বলে মনে হয় না।
ডিএসইর সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, স্বনামখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিকে শেয়ারবাজারমুখী করতে বিদ্যমান আইনেরও মৌলিক সংশোধন প্রয়োজন। তিনি বলেন, শেয়ারের ভালো মূল্য পাওয়া যায় না বলে কয়েক দশক ধরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনাকারী কোম্পানির উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজারে আসতে চান না। এ ক্ষেত্রে মৌলিক বাধা হলো শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া। আইপিওতে যে দামে শেয়ার বিক্রি হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে লেনদেন হয় শেয়ারবাজারে। অতিরিক্ত এ মূল্য কোম্পানি পেলে উদ্যোক্তারা তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী হতেন বলে মনে করেন তিনি।
এ সমস্যা দূর করতে আইপিওতে সরাসরি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রির প্রচলিত ধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা।
তবে আইপিও অনুমোদনের ভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি নয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। কমিশনের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে আন্ডাররাইটারের মাধ্যমে আইপিও বিক্রিতে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এ জন্য দেশের শেয়ারবাজার এখনও তৈরি নয়। ডিএসই মনে করছে, বর্তমান অবস্থায় প্রতিবছর অন্তত ২০-২৫টি নতুন কোম্পানির শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া সম্ভব। এর মাধ্যমে শিল্পে প্রতিবছর অন্তত দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার মূলধন জোগানের সক্ষমতা রয়েছে দেশের শেয়ারবাজারের।